(ছবি:সংগৃহীত)
শোকগাথা, শোকাবহ আগষ্ট শ্রাবণের মেঘের কালো অমানিশার পরিণতি বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ে জানান দিত আগষ্টের শোকগাথা পরিচয়! বলা চলে বৃষ্টিই শোকটাকে উঁচকে দিতো।বৈশ্বিক মহামারীর ধকল কাটতে না কাটতে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ তামাম দুনিয়ার লক্ষীর ভাঁড় খালি করে দিয়েছে।রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও রাজনীতিবিদদের দূরে ঠেলে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ব্যর্থতার মাশুল দিন শেষে নিরিহ আমজনতাকে চুকাতে হচ্ছে।কথায় আছে " পেটে খেলে,কানে সয়" কিন্ত খাওয়াতো দূরের কথা সংস্পর্শে না এসেও পিঠে- কানে চাপিয়ে দেয়া দূর্ভোগকে সাথি করে দিনগুজরান করে চলেছি...!এমনিতেই বাঙ্গালী ইমোশনাল জাতি,শোকে কাতর জাতি সপ্তাহব্যাপী জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে সয়ংক্রীয়ভাবে সকল নিত্য পণ্যই সুষমভাবে দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগীতায় স্ব- প্রতিভ!জাতি এখন শোকে কাতর,নিত্য পণ্যর দামে পাথরের উপক্রম।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠা বাঙালী ইতিহাস তথা উপমহাদেশের মহান নেতা, স্বাধীনতার স্হপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
" যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা, যমুনা বহমান
ততদিন রবে শেখ মুজিবুর রহমান"
এই শোকের মিছিলের পাল্লা দিন দিন ভারী হচ্ছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,ক্ষুদিরাম বসু,বীর শ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান,কবি শামছুর রহমান, আইভী রহমান,এবং সর্বকনিষ্ঠ শোকের পাল্লা ভারী করেছে ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত বঙ্গবন্ধু কন্যাকে জীবন উৎসর্গ করেছেন মাহাবুব - উর- রহমান মাসুদ।
আগষ্ট এলে আমার ভেতরে একটা কষ্টের জলীয়বাষ্প জমা হয়।তারপর সেই কষ্ট শ্রাবণের মেঘ হয়ে সারা মাস ঝড়ে ঝড়ে পড়ে ও তার রেশ থাকে আরও কিছুদিন।বারবার ফিরে ফিরে আসে সাদী মাহমুদের একটি গানের কথা " সে দিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল" আমি গাই, শত ব্যাস্ততার ফাঁকে ফাঁকে।এ যেন আমার বিলাশী কষ্টের বিনয়ী প্রকাশ আড়াল করবার জন্য গেয়ে চলা।আসলে এ কষ্টের বিনয়াবনত প্রকাশ ছাড়া দ্রোহে- বিদ্রোহে ক্ষুদ্ধ প্রতিবাদী প্রকাশ আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
কারণ আমি অতিতুচ্ছাতি তুচ্ছ, ভীতু ভেতো বাঙালী। তবে আমার বাঙালীয়ানার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত মনে হয়।তাই আগষ্ট এলে কষ্ট হয়।বাঙালি না হতে পারার কষ্ট, বাঙালি পরিচয় না দিতে পারার অব্যক্ত যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণা বয়ে চলেছি সেই কবে থেকে, সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিলো,ছিল না চাঁদ, হয়তো বা সে কি ভয়ংকর অন্ধকারের শেষ রাতের শ্রাবণ। তাই শ্রাবণ। তাই শ্রাবণ নিজে কাঁদে, আমাকে কাঁদায়।বাঙালির এ কান্না চিরন্তন। যতদিন শ্রাবণ আকাশে কাঁদবে, ততদিন বাঙালি কাঁদবে। এ তার হৃদয় হারানোর কান্না, তার জাত অভিমান কেড়ে নেবার কান্না।তার পৈতৃক সংস্কৃতি হারানোর কান্না,তার স্বজনের মত প্রিয় লোকজ ঐতিহ্য কেড়ে নেবার কান্না।
বাঙালি আজ তার কবিতা খু্ঁজে পায় না।গান খুঁজে পায় না,তার ছন্দ -সুর সব কেড়ে নিয়েছে শ্রাবণ।তাই শ্রাবণের কান্না দেখে মনে হয় ও বুঝি অনুতাপের অনুশোচনায় কেঁদে যায় ক্ষমার্য প্রণতি ভঙ্গিমায়। যদিও শ্রাবণ জানে এ তার মূঢ়তা, তবুও দায়ীকে চেতনায় পাপক্লিষ্ঠ পরিতাপিক বিশুদ্ধতার শৌচনিক প্রশ্রবণ মাএ।কিন্ত যত অনুশোচনায় দগ্ধ হও না কেন শ্রাবণ ; তোমার প্রতিটি ফোঁটা বাঙালির রক্তে লাল।এক সময় যে শ্রাবণের স্নিগ্ধ বৃষ্টি ফোঁটায় জড়ানে থাকতো কৃষ্ণ প্রিয় কদমের মাতাল গন্ধ তা এখন কলঙ্কিত বিষ তীক্ষ্ণ শরাগ্র হয়ে বাঙালি চেতনার অবয়ব করে বিদ্ধ। এ তীব্র যন্ত্রণার কাতরতা তুমি কি শুনতে পাও শ্রাবণ? এ আমাদের অনন্ত - যন্ত্রণার আন: শেষ কষ্ট। গভীর অনুরাগের প্রত্যয় দীপ্র সাবুজিক পেলবতার টকটকে লাল সূর্য অহংকারটুকু নেবার কষ্ট।
সিঁড়িতে আজও যে ছোপ- ছোপ রক্ত।ও তো বাঙালির রক্ত। লাল সবুজ পতাকার রক্ত, খোকার হাতের প্রিয় ছোট্ট বুড়ির মত মানচিত্রের রক্ত। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল,লালন, হামানের স্বপ্ন পুরুষ রাখাল রাজার রক্ত। এ রক্ত ধুয়ে দেবে এমন শূচি সুদ্ধ জলধারা তোমার কি আছে শ্রাবণ? তবে কেনো এ বৃথা প্রয়াস। নাকি বেদনায় আপ্লুত হয়ে সমব্যথী হতে আসো।
রাখাল রাজার বাবরের মৃদুলা মৃওিকার ঘ্রাণ নিতে? তাঁর কবরের মাটি এখন হিরের কুচি দিয়ে ঢাকা।ঘাসগুলো কবে সোনা ছোন হয়ে গেছে। প্রয়োজন নেই তোমার। শ্রাবণ, তুমি কি অনুভব করতে পেরেছিলে তার শেষ নি:শ্বাসের স্নিগ্ধতা? তার সাহসের মাপটুকু কি পরিমাপ করতে পেরেছে কখনো? পারো নাই।কারণ তোমার সেই পরিমাপের নিক্তি - স্কেলটা ওরা কেড়ে নিয়েছে।তাই তুমি অবুঝের মত শুধুই কেঁদে চলো অবিশ্রান্ত ধারায়। শ্রাবণ, আজও তোমার দুপুরে কদম ভোজ তোমারই বরিষণে,সন্ধ্যায় আজও কামিনী শাখায় গুচ্ছ গুচ্ছ শুভ্রতায় ফোটে শ্রাবন্তী ফুল।আমাদের বেলি বনে সতেজ পাপড়ি চুমায় না প্রিয়াসী ভ্রমর। হয়তো বা বুক ভরা অভিমানে ফিরে যায় বিষন্ন কষ্ট ঠোঁটে করে।রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণ সংগীত আর ভালো লাগে না। কালীদাসের মেঘদূত আর আগের মত প্রেম বিরহে কাতর করে না।তোমার কষ্ট কাব্য যে অনেক গাঢ় বেদনার কাব্য গাথা।তাই তো ছোটখাটো কোন কষ্ট আন্দোলিত করে না আর আমাদের। আচ্ছা শ্রাবণ, বলতে পারো,এমন বিধুরত বেদনার কাহিনী পৃথিবীতে ক'জন কবি পেরেছে লিখতে?কোন ভাবুকের ভাবনায় কি এসেছে উঠে এমন পৈশাচিকতার নির্মমতা?যে কাহিনী তুমি লিখলে নিষ্টুর পরিহাসপ শেষ রাতের কলঙ্কী কালিতে,সেই আসুরিক বর্বরতার উপমা কি আর একটি দিতে পারো শ্রাবণ?সেই ছোট্ট শিশুটির কথা মনে আছে তোমার? কি মিষ্টি মমতার প্রলেপ মাখানো ছিল তার মুখ। দু' চোখে কি দুষ্টুমি ভরা চঞ্চলতা। বাবার গায়ের গন্ধ ওর ভিষণ ভাল লাগত, তাই তো সুযোগ পেলেই বাবার কোল ঘেষে দাঁড়াত। বাপের নেওটা যাকে বলে।ওকেপ তোমরা মারলে।আমি নিশ্চিত ওর মুখে তখনো বাসি দুধের গন্ধ লেগে ছিল।শ্রাবণ তুমি আজ কাঁদো,অন্ততকাল ধরে তোমাকে কাঁদতে হবে এই বাংলায়।যে অবিনাশী কান্নার অঝর ধারায় তুমি কাঁদো, ওতো তোমার আকাশি জল নয় ও যে কপাল মন্দ বাঙালির বুকের রক্তক্ষরণ।চোখ ভরা স্বপ্ন ভঙ্গের অবিরাম,তাতেই বুঝি ওই আগরের জল এত নোনা।শ্রাবণ তুমিতো জানো ; আমরা ৫২ ' তে কেঁদেছি কিন্ত সে কান্না জাগরণ ছিল,ছিল সাহসী প্রতিবাদ, কেঁদে প্রতিবাদে ঘরে ফিরেছি। মা মমতার আঁচলে মুছে দিয়েছে প্রতিবাদ জমা মুখের ঘাম। স্নেহের আঁচল মুছে পাশপ শুইয়ে বাতাস করেছে তালপাখায়। সে কান্নায় ভাই হারানোর ব্যথা ছিল।ছিল প্রাপ্তির পারম্ভিক প্রশান্তি। তারপর কেঁদেছি ৭১' এ, সে কি ভয়ঙ্কর বিভীষিকা কান্না। বধ্যভূমে স্বজনের পচা গলা লাশের আড়ালে শএু নিধনের সুদৃঢ় ব্যুহ।
অসীম সাহসে দাঁড়িয়ে গেছে প্রাণ উৎসর্গে হাস্যোজ্জ্বল তেজস্বী যুবক।চোখে তার সোনালী স্বপ্ন, বুকে তার বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নেয়া প্রচন্ড সংক্ষুব্ধ হিংস্রতায় গড়া দুর্দান্ত প্রতিশোধী যন্ত্রণা। মুখে তার গগনবিদারী রণ হুংকার। পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই ওই যোদ্ধার বলিষ্ঠ হাতে উঁচিয়ে ধরা লাল সবুজ পতাকা কেড়ে নিতে পারে।সেই দিন পৃথিবীর সমস্ত মানুষ বিস্ময়ে নির্বাক চোখে তাকিয়ে দেখল বিজয়ী বাঙালির জনযুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধের গর্বিত মহানায়ককে।এ মহিমান্বিত আত্নত্যাগ পবিএ চোখের জলে মহীয়সী সম্ভ্রমের বিনিময়ে পেয়েছে জাতি তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ স্বাধীনতা। হাজার বছরের হারিয়ে যাওয়া সাত রাজার ধন,সোনা- স্বাধীনতা আমার!"কিন্ত শ্রাবণ ' ৭৫ এ যেন কান্নায় তুমি কাঁদিয়ে গেলে সেতো অশেষ কান্নার অবিরত শ্রাবণীয় করুণ ধারা। এ শুধু মেঘ মল্লার রাগে চির বিরহিণী বাংলার শোক সিক্ত মূর্ছনার অনি:শেষ হাহাকার। এ কান্নার শেষ কোথায়?
সে দিনের সেই অভিশপ্ত সকাল সে যে, হাজার রজনীর প্রগাঢ় অন্ধকারের আললেল্লায় আবরীতে অমখালীক অনঢ় তামশিক সকাল। সেই প্রভাতের প্রতিটি আলোক বিন্দুতে ছিল পাপ।বাতাসে ছিল বেঈমানের বিষাক্ত নি:শ্বাস। সেই বিষে আজও জাতি জর্জরিত। সেদিনেই জাতির আশা - আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন সাধ,ইতর ধারায় ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছ তুমি। তার দুর্গন্ধ আজও নাসিকায় অসহ্য। চেতনায় আমরা আজ নিরেট সৃজনতায় বন্ধ্যা মননে মেধায় ভয়ঙ্করভাবে পশ্চাৎপদ।দেশীয় সংস্কৃতিতে দু:খজনক বিতৃষ্ণা, বিশ্বদরবারে বাঙালি আজ হেয়, অবহেলিত। এদু:খ রাখব কোথায়? তোমার বৃষ্টি ধারায় সে দিন ঝড়ে ছিল তামাম পৃথিবী কদর্যতা। যে কারণে মাটি আজও বিষবৃক্ষ ফলায়,উৎপাদিত শস্য দানায় কীট।নষ্টামীর সর্বশেষ সূচকে আমাদের অবস্হান। শ্রাবণ, তুমি কি জান বাঙালির বুকে আজ কৃএিম হৃদপিন্ড। সেদিন হায়ানারা উপড়িয়ে নিয়ে গেছে আমাদের হৃদয়। এখন যেটা দেখছ ওটা বাঙালির হৃদয় নয়।ওতে পাবপ না বাঙালিয়ানার গন্ধ।আজ বাঙ্গালির রাখাল রাজা নকশিকাঁথার কাফনে চিরদিনের মত ঘুমিয়ে আছে ভূমি মাতার কোলে। বুকভরা অভিমান নিয়ে চলে গেছে সে অনন্ত অসীমে।শ্রাবণ ; একটি কথা রাখবে?যদি কখনো তোমার মেঘেদের সাথে দেখা হয় আকাশ গঙ্গার কোন পাড়ে। আমাদের সেই রাখাল রাজার সাথে।তবে বলো তার বাংলার এই দুর্দশার কথা। পারলে সে যেন দেখে যায় তার দু:খিনী মাকে।মা সে যে তার আজও পথ চেয়ে আছে। ছেলে তার আসবে মঙ্গলপ্রদীপ হাতে, রাখাল রাজার বেশে।