
আমি, আমরা গ্রামে জন্মানো, গ্রামে বেড়ে ওঠা মানুষ। ছোট্ট গ্রামটা ভর্তি ছিল বড় বড় মানুষে। সেই সব মানুষেরা শুধু ভালো মানুষ আর ভালোর গল্প শুনিয়েছে। কি ভালো, কেনো ভালো শেখাতো।
গ্রামে ভালো ছিল মন্দও ছিল। মন্দ টানতো না আমাদের। আনন্দে, প্রেমে, ভালোর আলোয়, সুখে শান্তিতে বড় হতে পেরেছিলাম।
আমরা চোর পুলিশ খেলেছি। খেলার সময়েও কেউ চোর হতে চাইতো না। আমরা লুডু খেলায় চুরি করে জিতেছি এবং তা অপরাধ বুঝে রাতে মন খারাপ হতো, চোখে ঘুম আসতো না। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে যেতাম।
আমাদের বড় হওয়া জুড়ে ছিল ঈদের আনন্দ, পুজার বাদ্য, মাহফিলের গজল, আজানের ধ্বনি আর খোল করতাল মন্দিরার সাথে হরিনাম। বাড়ির পশ্চিমদিকে শ্মশান আর বাড়ির পাশ দিয়েই সেখানে যাওয়ার রাস্তা। তাই হরহামেশা দেখতে হয়েছে শ্মশানযাত্রা।
বাড়িটার পূর্বদিকে দেয়াল ঘেঁসে মসজিদ ছিল আর মসজিদ থেকে কুড়ি হাত দূরে কালীমন্দির। কালীমন্দিরের মুখোমুখি কবরস্থান। তার কোল ঘেঁষে বাজার আর বাজারের দক্ষিন দিয়ে নদী বয়ে গেছে পশ্চিমের দিকে। পিছন দিকে ছিল বিশালাকার একটা বটগাছ। সে গাছ সারা বছর ধরে পাখিদের কিচির মিচির বিলিয়ে যেতো গ্রামে।
শহরে যাতয়াত করা বাস এসে থামতো বাড়ির সামনে। বাস থামতো বলে রাস্তার পাশে ছিল অনেকগুলো চায়ের দোকান। ভোরবেলা থেকেই সে দোকানগুলোয় অবিরাম বাজা শুরু হয়ে যেতো গ্লাসের ভিতর দ্রুত চামচ নাড়ানোর টুং টাং টুং।
রাজ্জাক মিস্ত্রির মাইকে বাজতো তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা- সে দুঃখের গান শুনে চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে যেতো মানুষ। ঠান্ডা হয়ে যেতো চা। থেমে থাকা বাসে ড্রাইভার উঠে বসলে যাত্রীরা অনুরোধ করতো- গানডা শেষ হলি পরে বাসে স্টার্ট দিয়েন ড্রাইভার সায়েব।
রেডিওতে নাটক শুনে কাঁদতো মানুষ। অনুরোধের আসর শুনতো পনেরো কুড়িজন গোল হয়ে বসে। আমরা গামলায় মুড়ি মেখে নিয়ে বসতাম ছাদে। সে ছাদে ওঠার কোনও সিঁড়ি ছিলনা। ওঠার জন্য শক্ত পোক্ত একটা মই ছিল। আম্মা ওঠা নামা ঝামেলা মনে করে রেডিওর সাথে জায়নামাজ সাথে নিয়ে ছাদে উঠতেন। মাগরিবের নামাজ শেষ করে ছাদ থেকে নামা হতো।
পাকিস্তান আমলে জন্ম। আম্মাকে একসময় ডেকেছি আম্মাজান বলে। আব্বাকে ডাকতাম আব্বাজান। তাঁরা ছিলেন নামাজ রোজা পালন করা মানুষ। যখন জানলেন, ক্লাস সেভেনে স্কুল নামাজ পড়া অভ্যাস করিয়েছে খুব খুশী হয়েছিলেন দুজনে।
ছেলে বড হয়ে যখন আর্ট কলেজে ভর্তি হতে চাইলো, আম্মাজান খুব খুশী হন- সন্তান সুন্দর বিষয় শিখতে চায়। আব্বাজানের আপত্তি ছিল, ছবি আঁকা মানুষের ভালো ভবিষ্যৎ হয় না ভেবে।
ভর্তি হয়ে গেলাম। স্বাধীনতার আন্দোলনে দেশ হয়ে গেলো উত্তাল। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন হয়ে গেলো দেশ। পাশ করে বেরিয়ে গেলাম। আব্বা আম্মা শুনতে পান, ছেলে ভালো আঁকে, ভালো অভিনয় করে। জানতে পারেন, দুটোর কোনটাই ভালো রোজগেরে কাজ নয়। তবু উদ্বিগ্ন হন না তাঁরা। আনন্দে থাকেন, ছেলে ভালো, গৌরব করার মতো কাজে আছে।
আম্মাজান আব্বাজান ছেডে একসময় আমরা আম্মা আব্বা ডাকা শুরু করি। আমাদের সন্তানেরা আমাদের ডাকে বাবা মা। সময়ের বদল। এই সময়ে চারদিকে অনেক ভালো, অনেক অনেক মন্দ। আমরা ওদের বলি না, ওটা ভালো, সেটা মন্দ। ওরা ভালো চিনে ভালোর মধ্যেই বড় হচ্ছে- সেটাতেই তিন ভাই বোনের আনন্দ।
বেদনা হচ্ছে ওদেরকে গ্রামে নিয়ে যাই, বহু পুরানো গল্প শোনাই কিন্তু গল্পের গ্রামটাকে দেখাতে পারিনা। সহস্র শব্দ বর্ণ আর গন্ধের মধ্যে আমরা বড হয়েছি- আমাদের সন্তানদের সেই শব্দ বর্ণ গন্ধের সামান্যও শোনাতে, দেখাতে, অনুভব করাতে পারিনা।
আমরা এই প্রিয় শহরটাকেও আমাদের ভাষায় বর্ণনা করি। ওরা শোনে আর যা নিজেদের দেখা- তার সাথে মেলানোর চেষ্টা করে।
বহুকালের পুরাতন বহু ভালো বদলে নতুন ভালো তৈরি করতে চায়, চেয়েছে মানুষ। কতটুকু লাভ বা কি পরিমান লোকসান হয়েছে তাতে, তার খোঁজ কেউ কখনো করেছে বলে মনে হয় না।
তবু স্বপ্ন দেখি, আশা আছে। আমাদের পক্ষ থেকে বাংলা নতুন বছরে সবার জন্য শুভকামনা।