বুধবার,

১৮ জুন ২০২৫

|

আষাঢ় ৫ ১৪৩২

XFilesBd

ব্রেকিং

২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থ-উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। মোট বাজেট -৭,৯০,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা-৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি -২,২৬,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬%) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা-৫

করোনা সাময়িক কিন্তু বছরজুড়ে মহাসড়কে মানুষ হত্যা

করোনার চেয়েও ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা। গলি থেকে রাজপথে মৃত্যুর মিছিল। অসহিষ্ণু চালকের দল, চুপচাপ সরকার

শিউলী সিকদার

প্রকাশিত: ১৫:৪৯, ১৭ জুন ২০২৫

আপডেট: ১৬:০৩, ১৭ জুন ২০২৫

করোনার চেয়েও ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা। গলি থেকে রাজপথে মৃত্যুর মিছিল। অসহিষ্ণু চালকের দল, চুপচাপ সরকার

২০২০ সালের শুরুতে যখন পৃথিবীজুড়ে এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক নেমে আসে, বাংলাদেশও এর বাইরে ছিল না। করোনাভাইরাস যেন এক ছায়ামৃত্যু হয়ে প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসা ব্যবস্থা হিমশিম খায়, লকডাউনে থেমে যায় জনজীবন। কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা সেই মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি। কিন্তু এরই মাঝে আরেকটি “নীরব মহামারি” গড়ে উঠেছে—সড়ক দুর্ঘটনা। করোনার তিন বছরে মোট মৃত্যু যেখানে আনুমানিক ২৯-৩০ হাজার, সেখানে বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৭ হাজারেরও বেশি। তাহলে প্রশ্ন ওঠে—সড়কে কি মৃত্যুর চেয়ে জীবনের দাম কমে গেছে?

পরিসংখ্যান যখন ভয় পাইয়ে দেয়: সরকারি ও বেসরকারি একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭,০০০ থেকে ৯,০০০ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। শুধু ২০২২ সালেই সড়কে প্রাণ গেছে ৯,৯৫১ জনের (নিসচা রিপোর্ট অনুযায়ী)। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা গেছেন আনুমানিক ২৯,৪০০ জন। নিচের এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, এগুলো হারিয়ে যাওয়া জীবন, ক্ষতবিক্ষত পরিবার এবং ভবিষ্যৎ হারানোর নির্মম দলিল।

 

বছর     সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু

২০২০   ,১৪৭  ,০০০+

২০২১   ,৮০৯ ,৩৪৮

২০২২   ,৯৫১ ,৩৮৭

২০২৩  ,৪৩১ ,২৩৫

(উৎস: নিরাপদ সড়ক চাই, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)

দেশে এখনও লাখো চালকের কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই। অনেকেই ফিটনেসহীন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হন। প্রশিক্ষণহীনতা এবং লাইসেন্স বাণিজ্য এক ভয়াবহ বাস্তবতা তৈরি করেছে। তাছাড়া বাস-মালিকরা চালকদের সময় বেঁধে দেন—১০ মিনিটে পরের স্ট্যান্ডে না পৌঁছালে বেতন কাটা। এতে চালকেরা গতি বাড়াতে বাধ্য হন। দুর্ঘটনার রাস্তাটি শুরু হয় এখানেই।

বাংলাদেশের বহু সড়কে নেই জেব্রাক্রসিং, নেই ফুটওভার ব্রিজ। সংকীর্ণ ও ভাঙা সড়কে চলছে ভারি যান। দ্রুতগতি ও অবকাঠামোর অসমতা দুর্ঘটনার জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। এছাড়া একজন হেলমেট ছাড়া বাইকারকে জরিমানা করতে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশ যদি আর্থিক “সমাধান”-এ চলে যায়, তাহলে জনমানসে “নিয়ম ভাঙা” উৎসাহিত হয়।

মজার ব্যাপার হলো—একজন যাত্রীও যদি জানেন যে বাসের চালক অদক্ষ, তিনিও চুপচাপ বসে থাকেন। আমাদের সচেতনতা সেখানে সীমাবদ্ধ, যেখানে আমাদের সুবিধা ক্ষুণ্ন না হয়।

সমাজ ও রাষ্ট্রের মনস্তত্ত্ব নিয়েও প্রশ্ন আছে। করোনা ছিল চোখে দেখা যায় না এমন এক ভয়। ফলে মানুষ ভয় পেয়েছিল। ঘর থেকে বের হয় না, মাস্ক পরে, সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যু দৃশ্যমান হলেও সেটি যেন “সাধারণ” হয়ে গেছে। প্রতিদিন কেউ না কেউ মরে, তাই যেন আমরা আর গা করি না। এটিই হচ্ছে “ডেঞ্জার নর্মালাইজেশন”—যেখানে প্রাণহানিও অভ্যস্ততা হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন তাহলে রাষ্ট্র কি করছে?

সরকার ২০১৮ সালে “নিরাপদ সড়ক আইন” পাস করেছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন খাতায় কলমেই সীমাবদ্ধ।

অভিযোগ রয়েছে, মালিক-শ্রমিক ইউনিয়নের চাপে সরকার সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারে না। এছাড়া বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের দুর্নীতিও দায় এড়াতে পারে না। এটি রোধ করা সম্ভব যদি কি না জাল লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে। কঠোর পরীক্ষা ও ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি চালক ও পরিবহন মালিকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত, ড্রাইভারদের নির্ধারিত কাজের সময়, বিশ্রাম ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। সড়ক আইনের প্রয়োগে যেন কোনো পক্ষপাত বা আপস না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

সিসিটিভি, ট্রাফিক লাইট, স্পিড ক্যামেরা ও রোড ডিজাইন আন্তর্জাতিক মানের করা দরকার। একইভাবে স্কুল-কলেজে ট্রাফিক সচেতনতা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

করোনাভাইরাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই। অথচ সড়কে প্রতিদিন সেই জীবনই অবহেলায় ঝরে পড়ছে। প্রতিটি মৃত্যুই প্রতিরোধযোগ্য, যদি আমরা রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি—তিন পর্যায়ে দায়িত্ব নিতে শিখি। সুতরাং আজ সময় এসেছে প্রশ্ন করার—একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন সড়কে জীবন নিরাপদ হবে না কেন