বুধবার,

১৮ জুন ২০২৫

|

আষাঢ় ৪ ১৪৩২

XFilesBd

ব্রেকিং

২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থ-উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। মোট বাজেট -৭,৯০,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা-৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি -২,২৬,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬%) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা-৫

অগ্নিগর্ভ ইরান কি বাংলাদেশকে পাশে পাবে?

পুলক ঘটক

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৬ জুন ২০২৫

আপডেট: ১৫:১৫, ১৭ জুন ২০২৫

অগ্নিগর্ভ ইরান কি বাংলাদেশকে পাশে পাবে?

বাংলাদেশ থেকে সাড়ে চার হাজার মাইল দূরবর্তী একটি দেশ ইরান। সে দেশের প্রতি আপনার অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু যদি হয় ‘ধর্মীয় বিশ্বাস’, তবে আমার সাথে এর সম্পর্ক কী? আমি তো ইসলাম বিশ্বাস করি না। ধর্মের ব্যাপার হলে ইরানের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য অমুসলিম দেশ ও জনগণের অনুভূতির ভিত্তি কী হবে? 

কথাটা সবার বোঝার জন্য বলছি। যখন ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে আপনি মানবিক ও অন্যান্য সম্পর্কগুলো নির্ধারণ করবেন, তখন এ প্রশ্ন নিয়েও আপনাকে ভাবতে হবে। 

ইসরায়েলের ১৮.১% নাগরিক মুসলিম (বাংলাদেশে সংখ্যালঘু অমুসলিম নাগরিকের সংখ্যা তার তুলনায় অনেক কম)। গত শুক্রবারের পর থেকে ইরানের হামলায় এখন পর্যন্ত ১৪ জন ইসরায়েলের নাগরিক নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত চারজন প্যালেস্টাইনি মুসলিম বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। বলুন তো, এই মুসলিম ইসরায়েলিরা এখন ইসরায়েলকেই সমর্থন করবে, না কি ইরানকে? ধর্ম, রাষ্ট্র এবং তার সাথে মানুষের সম্পর্ক মিলিয়ে নিন। 

শিয়া শাসিত ইরানে প্রায় ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু সুন্নি ছাড়াও কিছু খ্রিস্টান, জরথুষ্ট্রীয়, ইহুদি, বারহাই’, মানদায়ান, এবং ইয়াসানির মতো সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ রয়েছে। ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে অনুভূতি নির্ধারিত হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা কোন দিকে অবস্থান নেবে? 

মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়িত করতে চাইলে ইরান বর্তমানে ‘মানুষের দেশ’ নয় –এটি শিয়াদের কর্তৃত্বে চালিত শিয়াদের দেশ। সেখানকার রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি এরকমই। ফলে সেখানে সংখ্যালঘু সুন্নিদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তেহরানে সরকার অনুমোদিত কোনো সুন্নি মসজিদ নেই; সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ, প্রশাসনিক উচ্চপদে সুন্নিরা অংশ নিতে পারে না; ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সীমিত; কখনো কখনো বন্ধও করা হয়।

একাধারে তারা জাতিগত সংখ্যালঘু (বেলুচ, কুর্দ, তুর্কমেন) হওয়ায় দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতা দ্বিগুণ। তাদের জীবনধারণের উপর তদারকি, গ্রেপ্তার এবং ধর্মচর্চায় নিয়ন্ত্রণ নিয়মিত। 

সুন্নিদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ইহুদিরা সেখানে ভালো আছে। অতি অল্পসংখ্যক ইহুদি থাকলেও তাদের সরকারি স্বীকৃতি আছে এবং পার্লামেন্টে ১টি আসন নির্ধারিত আছে। তেহরানে সিনাগগ ও স্কুল চালু রয়েছে। 

পৃথিবীতে পুরাতন মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান গণনা করলে পারস্য (সাবেক ইরান) তার একটি। ইরানের মতো সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। সেই দেশটি এখন মানুষের দেশ নয় –একটি সম্প্রদায়ের দেশ! 

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর প্রথম দফায় কমিউনিস্টদের তুদেহ পার্টিসহ বিভিন্ন বিরোধী দল ও মতের প্রায় ৯ হাজার মানুষকে ইরানের শিয়া জেহাদিরা হত্যা করেছিল। বিপুল সংখ্যক মানুষ পালিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। 

সেই বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে প্রায় ৩০ হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে বড় অংশ কমিউনিস্ট ও বাম কর্মী। বলুন দেখি, সেই নিহতদের পরিবার-পরিজন ও দেশান্তরী হওয়া ইরানীরা কোন পক্ষ নেবে? মানুষের অনুভূতি কি কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর? 

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবে ক্ষমতা হারানো মোহাম্মদ রেজা শাহ পেহলভি পলাতক জীবনে থেকে ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর শাহবানা, উত্তরাধিকারী এবং বাকি পরিবার চলমান ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে প্রকাশ্যে ইরানের বর্তমান শাসকদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রবাসী বর্তমান ‘যুবরাজ’ রেজা পেহলভি এই যুদ্ধে ইরানের শিয়া শাসকদের উৎখাতের জন্য পশ্চিমাদের সহায়তা চেয়েছেন। 

একটি দেশের প্রতি নাগরিকদের সমর্থন কতপ্রকার অনুভূতি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট হতে পারে চিন্তা করে দেখুন। এ কি কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর বিষয়? ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমর্থন চাইলে তো শুধুমাত্র ইসলামী শিয়া-বিশ্বাসী দেশ অথবা ইসলাম বিশ্বাসী মানুষ ছাড়া বাকি পৃথিবীর সবাইকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়া আপনার স্বাভাবিক নিয়তি।

আমি আমার নিজের কথা বলি। অবস্থানগত, রাজনৈতিক মত, ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি — ইত্যাদির কোনো ক্ষেত্রেই ইরানের শাসকদের সাথে আমার নৈকট্যবোধ নেই। সাধারণ মানব-বোধের বাইরে আর কোন কোন বিষয় ইরান অথবা ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের ক্ষেত্রে আমার অনুভূতিকে তাড়িত করতে পারে? 

এখন থেকে মাত্র তিন বছর আগে ২০২২ সালে নারী-মুক্তি ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করার কারণে ইরানে প্রায় ৬০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে –যার মধ্যে অন্তত ৬৩ জন নারী ও ৪৭ জন কিশোরী রয়েছেন। নারী আন্দোলনে সম্পৃক্ত মজিদরেজা রহমানভর্ড নামে ২৩ বছর বয়সী এক তরুণকে প্রকাশ্যে ক্রেনে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। “আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে”র অভিযোগে এক দিনের মধ্যে তাঁর বিচার ও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে ইরানের বিপ্লবী সরকার। 

আমি নারী-আন্দোলনের একজন উচ্চকণ্ঠ কর্মী। আমি ইরানের হলে হয়তো এভাবে ফাঁসিতে ঝুলতাম। পোশাকের কারণে মাহশা আমিনীর হত্যা আমার হৃদয়বোধকে তাড়িত করে। আন্দোলনে গিয়ে ফাঁসিতে ঝোলা মানুষগুলোকে আমি সহযোদ্ধা অনুভব করি। আর, ইরানের শিয়া শাসকদের আমি কাতেল হিসেবে দেখি। 

ইসরায়েল আমার কাছে ব্যাপার নয়; পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের সহযোগিতায় আমি ইরানের বর্তমান শাসকদের পতন চাই। সেই মহান পারস্যের নবউত্থান দেখতে চাই –অবশ্যই তা ধর্মনিরপেক্ষ উত্থান; মানুষের উত্থান। 

আপনি ধর্মীয় বিশ্বাস বা সম্প্রদায়গত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্তমান ইরানের পক্ষে থাকতে চাইলে সেটা আপনার ব্যাপার –অন্যদের কাছে আশা করা উচিত নয়। জয় মানুষ।
পুলক
শুক্রবার (১৩ জুন ২০২৫) ইসরায়েলের হামলায় ইরানে নিহতের সংখ্যা একশো'র কাছাকাছি। তাদের মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীসমূহের প্রধান, উপপ্রধান, ইসলামী বিপ্লবী গার্ডের প্রধানসহ অন্তত ১৪জন শীর্ষ সামরিক কমান্ডারের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। সাথে অন্তত ছয়জন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হওয়ার কথা ইরান নিশ্চিত করেছে। 

তারা সবাই এক হামলায় একজায়গায় মারা গেছেন, এমন নয়। বিভিন্নজন বিভিন্ন জায়গায় মারা গেছেন। তাদের লোকেশন ট্র্যাক করে এমন নিখুঁতভাবে হামলা পরিচালনা করা কিভাবে সম্ভব হলো, সামরিক বিশ্লেষকদের কাছেও তা এক বিষ্ময়! অনেকেই বলছেন, ইরানের জনগণের ভেতর থেকে সহযোগিতা ছাড়া শুধু প্রযুক্তি দিয়ে এটা সম্ভব নয়। 

 রাষ্ট্রটি যখন নিজের সেনাপ্রধানের প্রাণ রক্ষা করতে পারে না, তখন এর সক্ষমতা বা দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। নাগরিকদের (বিশেষত নারীদের) স্বাধীনতাহীন একটি দমনমূল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্যক্তিত্বপূর্ণ স্বাধীন জনসমাজ বা জনবল গঠনে ব্যর্থ হওয়ায় অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও বিভেদে ক্ষয়ে গেছে ইরানের শক্তি। 

? নিহত সামরিক কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের মধ্যে শীর্ষ ২০ জনের তালিকা:  

১. মেজর জেনারেল হোসেইন সালামী – ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC)-এর প্রধান কমান্ডার ও শীয়া শাসনের অন্যতম নিয়ামক। ইরানি সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একজন ছিলেন। তিনি প্রথম পর্যায়ের হামলায় নিহত হন। 

২. মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি – ইরান সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ। সামগ্রিকভাবে ইরানের প্রতিরক্ষা নীতি ও কমান্ড পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন। 

৩. মেজর জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ – IRGC-এর অ্যারোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার। তিনি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তির প্রধান স্থপতি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
 
৪. মেজর জেনারেল গোলাম আলী রাশিদ – খাতাম-আল-আনবিয়া সদর দপ্তরের প্রধান। এটি ইরানের সামরিক কৌশলগত কমান্ডের অংশ।
 
৫. দাউদ শেইখিয়ান – ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ডের বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিটের কমান্ডার। ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরু দায়িত্বে ছিলেন।

৬. তাহের পূর – IRGC ড্রোন ইউনিটের কমান্ডার। ইরানের আক্রমণাত্মক ড্রোন ইউনিটের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। 

৭. এসমাইল কায়ানি – কুদস ফোর্সের কমান্ডার। তিনি কাসেম সোলেইমানির মৃত্যুর পর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। (কয়েকটি মিডিয়ায় তাকে নিহত বলা হলেও এটি এখনও ১০০% নিশ্চিত নয়।)

৮. আলী শামখানি – ইরানের সর্বোচ্চ নেতার উপদেষ্টা ও প্রাক্তন নৌ-অ্যাডমিরাল। হামলায় গুরুতর আহত হন এবং পরে মৃত্যুবরণ করেন বলে রাষ্ট্রীয় মিডিয়ায় জানানো হয়। 

 পরমাণু বিজ্ঞানী ও গবেষক:

৯. ফারেদুন আব্বাসি-দাবানি – ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান। অতীতেও তিনি ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থার টার্গেট ছিলেন।

১০. মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি – পরমাণু পদার্থবিদ ও গবেষক। 'শাহিদ বেহেশতি ও আজাদ' বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১১. আবদুল হামিদ মানুচেহর – বিজ্ঞানী ও গবেষক; ইরানের গোপন পরমাণু গবেষণা প্রকল্পের অংশ ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

১২. আহমদ রেজা জোলফাঘারি – পদার্থবিদ ও গবেষক; মূলত সেনাবাহিনীর পারমাণবিক প্রকল্পে সহায়তা করতেন।

১৩. আমির হোসেইন ফেগি – পরমাণু প্রকৌশল বিষয়ে কাজ করতেন এবং বিভিন্ন গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

১৪. মোতালেবিজাদে – বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি গোপন সামরিক প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। 

১৫–২০. ছয়জন আরও সিনিয়র কমান্ডার – ইরানের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়ার সূত্র মতে, হামলায় আরও ছয়জন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, যাদের নাম এখনও প্রকাশিত হয়নি  । 

এই ব্যক্তিবর্গ ইরানের সামরিক ও পরমাণু কাঠামোর সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের অংশ ছিলেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় বিশ্লেষকরা বলেছেন, তাঁদের মৃত্যু ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা এবং পরমাণু কর্মসূচির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে

(লেখক মুক্তমনা সাংবাদিক)