
বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে তামাক চাষ। চাষিদের প্রলুব্ধ করছে বহুজাতিক তামাক কোম্পানির আর্থিক প্রণোদনা, সেচ সুবিধা, উচ্চমূল্যের আশ্বাস এবং সহজ শর্তে কৃষিঋণ। কিন্তু এই লাভের মোহে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ ecological বিপর্যয়—মাটির উর্বরতা হ্রাস, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং অন্যান্য খাদ্যশস্যের চাষে সংকট।
তামাক একটি উচ্চ-নিউট্রিয়েন্ট গ্রহণকারী গাছ। এক হেক্টর তামাক জমি থেকে গড়ে ৫০-৭০ কেজি নাইট্রোজেন, ১৩-১৫ কেজি ফসফরাস এবং প্রায় ১৪০ কেজি পটাশ বেরিয়ে যায়। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মাত্রায় পুষ্টি উপাদান হারানোর ফলে মাটির জৈব গঠন ধ্বংস হচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে কোনো খাদ্যশস্য ফলানো কঠিন হয়ে পড়বে।
চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, বান্দরবান, নীলফামারী ও লালমনিরহাট অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে, যেখানে পাঁচ বছর আগেও ধান, পাট, ভুট্টা ও গম হতো, সেখানে এখন শুধু তামাক। স্থানীয় কৃষক আবুল কাশেম জানান, “তামাকে লাভ হয় ঠিকই, কিন্তু পরে আবার অন্য ফসল ফলাতে গেলে মাটি চায় না।”
রাতারাতি লাভ, দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি: তামাক চাষিদের লক্ষ্য থাকে অল্প সময়ে বেশি টাকা আয়। ফলে তারা গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি না দেখে দ্রুত রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। একটি মৌসুমে একরপ্রতি ৮০ থেকে ১২০ কেজি পর্যন্ত ইউরিয়া, টিএসপি ও পটাশ প্রয়োগ হয়। এই অতিমাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার জমির জৈব পদার্থ (organic matter) ধ্বংস করে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল খায়ের বলেন, “একটানা তিন বছর তামাক চাষ হলে ঐ জমিতে পরবর্তীতে কোনো খাদ্যশস্য ফলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এতে শুধু জমিই নয়, আশপাশের পরিবেশও বিষাক্ত হয়ে ওঠে।”
পানির স্তরে প্রভাব: তামাক চাষে পানির চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি। গ্রীষ্ম মৌসুমে যখন পানির স্তর স্বাভাবিকভাবেই নিচে নেমে যায়, তখনও তামাকচাষীরা গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দিয়ে জমি চাষ করেন। এতে একদিকে মাটির নিচের পানির স্তর কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে আশেপাশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। বান্দরবানের রুমা উপজেলার এক স্কুলশিক্ষক বলেন, “তামাক চাষ শুরুর পর থেকে আমাদের এলাকায় ঝরনার পানিও শুকিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের লোকজন এখন ২-৩ কিলোমিটার হেঁটে পানি সংগ্রহ করে।”
খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি: দেশের উত্তরাঞ্চলে খাদ্য উৎপাদনের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল কুষ্টিয়া ও নীলফামারী। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে শুধু কুষ্টিয়াতেই প্রায় ৫,২০০ হেক্টর জমি খাদ্যশস্য থেকে তামাক চাষে রূপান্তরিত হয়েছে। এতে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “তামাক চাষের ফলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ জীবিকা ব্যাহত করবে।”
তামাক শুধু জমির ক্ষতি করছে না, এটি চাষিদের স্বাস্থ্যকেও বিপন্ন করছে। তামাক গাছ চাষ ও শুকানোর সময় যে ধোঁয়া ও কেমিক্যাল তৈরি হয়, তা সরাসরি ত্বক, শ্বাসনালী ও চোখের জন্য ক্ষতিকর। বহু চাষি দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি ও চর্মরোগে ভুগছেন।
তামাক কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিক চাষির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে বীজ, সার ও নগদ অর্থ সরবরাহ করে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তামাক কোম্পানির মাঠকর্মীরা আমাদের তথ্য লুকিয়ে রাখে, কৃষকদের ভুল তথ্য দিয়ে প্ররোচিত করে। যদিও সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন’ শক্তিশালী করছে, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এর বাস্তবায়ন দুর্বল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাকের বিকল্প উচ্চমূল্যের অর্থকরী ফসল যেমন সূর্যমুখী, আলু, শাকসবজি বা তিল চাষে উৎসাহ দেওয়া গেলে কৃষকরা ধীরে ধীরে তামাক থেকে সরে আসবে। পাশাপাশি প্রণোদনা মূলক কৃষি ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন প্রয়োজন। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রহমান বলেন, “তামাক চাষ নিষিদ্ধ না করে, এর বিকল্প চাষের জন্য সরকারকে কৃষিকে টেকসই করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।”
তামাক চাষে সাময়িক আর্থিক লাভ থাকলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ভয়াবহ। জমির উর্বরতা হারানো, পানির স্তর হ্রাস এবং খাদ্য উৎপাদনের সংকট দেশের কৃষি ব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় হুমকি। এখনই কার্যকর নীতিমালা, মাঠপর্যায়ে সচেতনতা এবং বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে, টেকসই কৃষির স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।