
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ইয়াবার ভয়াবহ বিস্তার নিয়ে যখন শহুরে মিডিয়াগুলো মনোযোগ দিচ্ছে না, তখন গ্রামগুলোতে নিঃশব্দে গড়ে উঠছে এক বিপজ্জনক মাদক সাম্রাজ্য। এক সময়ের ধানখেত, পুকুর, খেলার মাঠের প্রান্তে যেখানে সন্ধ্যার পর শিশুদের খেলাধুলা আর কৃষকদের গল্পগুজব ছিল, সেখানে এখন দেখা যায় কিশোরদের দল বেঁধে ছুটে চলা—মুখ চেপে হাসছে, চোখ লাল, আচরণ অস্বাভাবিক। স্থানীয়ভাবে অনেকে বলছেন, “ছেলেটা বদলে গেছে”, কেউ কেউ বলছেন “ওরা ইয়াবায় পড়ে গেছে”—কিন্তু সমস্যার গভীরতা উপলব্ধি করতে গেলে শুধু চোখে দেখা বা কানে শোনা যথেষ্ট নয়।
পাহাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে নদীপথের গহীন ঘাট পর্যন্ত, ইয়াবা এখন আর শুধু কক্সবাজার বা টেকনাফ কেন্দ্রিক সংকট নয়। এই মাদক প্রবেশ করেছে ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রাম, পটুয়াখালী, নড়াইল, বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতেও। কিছু ক্ষেত্রে এই বিস্তার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হচ্ছে, আবার কিছু জায়গায় স্থানীয় পুলিশ, মেম্বার, চেয়ারম্যানদের নিরব সম্মতি বা সংশ্লিষ্টতা থাকছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি উপজেলার সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “ইয়াবা এখন টাকা বানানোর সহজ রাস্তা। স্থানীয়ভাবে যারা ‘চান্দা’ দেয়, তাদের আর কেউ কিছু বলে না। পুলিশও দেখে না, কারণ ভাগসই হয়ে যায়।”
বিশ্লেষকদের মতে, মাদক ব্যবসা এখন আর শহর-ঘেঁষা এলাকা বা বড় বড় মাফিয়াদের হাতে নেই, বরং গ্রাম পর্যায়ের তরুণদের মধ্যেও এর বিস্তার ঘটেছে। তারা নিজেরাই এজেন্ট, নিজেরাই বিক্রেতা এবং অনেক ক্ষেত্রেই নিজেরাই ভোক্তা। গ্রামের কিশোর-তরুণদের একটি বড় অংশ চাকরি বা শিক্ষার নিশ্চয়তা না পেয়ে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে ইয়াবার প্রলোভনে জড়িয়ে পড়ছে। ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী একাধিক তরুণ এমনকি স্কুলে পড়ুয়া কিশোরদের মাঝেও ‘একবার খেলে আর ছাড়তে পারি না’—এই স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে।
একটি ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের ওপর করা এক বেসরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি গ্রামের গড়ে ২৫-৩০ জন কিশোর/তরুণ নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ইয়াবা গ্রহণ করছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই পরিবারকে জানায় না, অথচ আচরণগত পরিবর্তন, চুরির প্রবণতা, নিস্পৃহতা, আগ্রাসী মেজাজ—সব কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এক স্কুল শিক্ষিকা জানান, “আগে ছাত্ররা ক্লাসে মনোযোগী ছিল, এখন কয়েকজনের চোখ লাল, ঘুমায়, হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায়।”
স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে অভিযান চালানো হয়, তবে এসব বেশিরভাগই লোক দেখানো বলে অভিযোগ রয়েছে। একাধিক গ্রামে রাতের বেলা ইয়াবা বিক্রির হাট বসে, যেখানে বাইরের লোকজন এসে কিনে নেয় আবার স্থানীয়রাও খুচরা ব্যবসা করে। গ্রামের চায়ের দোকান, মোবাইল রিচার্জের দোকান কিংবা অস্থায়ী রিকশার গ্যারেজগুলোও এই বাণিজ্যের আড়াল হয়ে উঠেছে। এর পেছনে আছে যোগাযোগের সহজলভ্যতা—স্মার্টফোনে বিকাশ, নগদের মাধ্যমে টাকা আদানপ্রদান হয়, আর পণ্য পৌঁছে যায় মোটরসাইকেলে বা কখনো সাইকেলে।
একজন সাবেক মাদকাসক্তের ভাষায়, “শুরুটা করেছিলাম বন্ধুর সাথে মজা করে, পরে আর ছাড়তে পারিনি। তারপর নিজেই বিক্রি শুরু করলাম যাতে নিজের টানটা মেটাতে পারি।” এই কথাগুলো শুধু তার একার নয়—গ্রামবাংলার বহু তরুণ আজ এই একই পথে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পরিবার যদি একসাথে উদ্যোগ না নেয়, তাহলে ইয়াবার এই আগ্রাসন রুখে দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও উচিত হবে শুধু শহর কিংবা সীমান্ত নয়, বরং গ্রামের অলিগলিতে নজরদারি বৃদ্ধি করা। বিশেষ করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। মাদকবিরোধী অভিযানকে রাজনৈতিক ঢাল বা প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে না ব্যবহার করে, তা যেন সত্যিকারের সামাজিক মুক্তির অংশ হয়, সে ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি।
গ্রামগুলোতে ইয়াবার যে নিঃশব্দ বিস্তার ঘটছে, তা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে যে শুধু অর্থনৈতিক বা স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে তাই নয়, বরং একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ও সামর্থ্যকেও ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবে—এমনটাই আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। এখনই সময়, রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজ একযোগে মুখোমুখি হোক এই সর্বনাশা ঝড়ের। না হলে গ্রামীণ বাংলার ভবিষ্যৎ এক ভয়াবহ দুর্যোগের দিকে ধাবিত হবে।