রোববার,

১৩ জুলাই ২০২৫

|

আষাঢ় ২৯ ১৪৩২

XFilesBd

ব্রেকিং

২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থ-উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। মোট বাজেট -৭,৯০,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা-৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি -২,২৬,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬%) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা-৫

মব সন্ত্রাসের নেপথ্যের সিন্ডিকেট নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

মব সন্ত্রাসে রক্তাক্ত বাংলাদেশ। আতঙ্ক কুঁড়ে খায় পথচলতি মানুষের

শিউলী সিকদার

প্রকাশিত: ০২:৫৭, ১৩ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ০৩:১৯, ১৩ জুলাই ২০২৫

মব সন্ত্রাসে রক্তাক্ত বাংলাদেশ। আতঙ্ক কুঁড়ে খায় পথচলতি মানুষের

মব সন্ত্রাস এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো জনরোষ নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার এক গভীর ও দুঃখজনক উপসর্গ। শিশু চোর সন্দেহে গণপিটুনি, ধর্ম অবমাননার নামে জনতার হাতে হত্যা, অথবা রাজনীতিক বিরোধে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিপক্ষকে লাঞ্ছনা—এসব দৃশ্য আজকাল প্রায়ই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং আমাদের সামনে তুলে ধরে এক ভয়ানক বাস্তবতা: মানুষজন আইন, বিচার ও সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে নিজেরাই বিচারকের ভূমিকা নিচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—কেন এই প্রবণতা বাড়ছে? কারা এই সন্ত্রাসের মদদদাতা বা নেপথ্যের কুশীলব?

মব সন্ত্রাসকে এককভাবে জনরোষ হিসেবে ব্যাখ্যা করলে তা বাস্তবতাকে আড়াল করে। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সন্ত্রাসের নেপথ্যে থাকে একটি পরিকল্পিত উসকানি, গুজব, প্ররোচনা এবং রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত স্বার্থরক্ষা। ২০১৯ সালের ‘পদ্মা সেতুতে শিশু বলি’ গুজব কিংবা ২০২০ সালে কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা—সবই ছিল সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো বিভ্রান্তিকর তথ্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উস্কানির ফল। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে, এসব গুজব ছড়ানোর পেছনে সক্রিয় ছিল কিছু সংঘবদ্ধ চক্র, যাদের লক্ষ্য ছিল জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী পক্ষ উভয়ই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে জনতাকে ‘সড়কে’ নামাতে উৎসাহিত করে, বিশেষ করে যখন বিচারব্যবস্থার ওপর তাদের আস্থা কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে দলীয় স্বার্থে, ধর্মীয় অনুভূতিকে হাতিয়ার করে, অথবা সামাজিক বিভক্তিকে উসকে দিয়ে কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে গণমানুষকে সহিংস করে তোলে। অনেক সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক গোষ্ঠীও এমন ঘটনা ‘দমন নীতি’র অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে, এবং বিরোধী পক্ষকে দমন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে।

তবে রাজনীতিই শুধু নয়। বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য, শিক্ষার অভাব, এবং বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতাও এই মব সন্ত্রাসকে উসকে দিচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জনগণের মধ্যে এক ধরনের ‘বিকল্প বিচার’-এর প্রবণতা তৈরি করেছে। মানুষ বিশ্বাস হারিয়েছে যে অপরাধী আদালতের মাধ্যমে সাজা পাবে। ফলে কেউ অপরাধী মনে হলে জনতা নিজেই তাকে শাস্তি দেয়। এক অর্থে এটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতাই।

বিশেষত সামাজিক মাধ্যমের উত্থান মব সন্ত্রাসকে ডিজিটাল উন্মাদনায় পরিণত করেছে। মিথ্যা ভিডিও, বানোয়াট ছবি, বিভ্রান্তিকর স্ট্যাটাস মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে, এবং জনতা একসাথে তাতে প্রতিক্রিয়া জানায়—প্রথমে ক্ষোভ, পরে ভীতি, তারপর হিংস্রতা। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় স্থানীয় ইউটিউবার, ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট বা তথাকথিত “ডিজিটাল যোদ্ধারা” মূল উস্কানিদাতা হিসেবে কাজ করে, যাদের অনেকেই রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুসন্ধানে এমন বহু ডিজিটাল অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে, যেগুলোর পরিচালনায় জড়িত ব্যক্তি কোনো না কোনো দল বা গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় সক্রিয়।

মব সন্ত্রাস অনেক সময় অপরাধ ঢাকতে ব্যবহৃত হয়। একটি বিশিষ্ট উদাহরণ ২০২২ সালের শেরপুরে, যেখানে চুরি ধামাচাপা দিতে নিরপরাধ এক যুবককে ‘চোর’ বলে জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয়, এবং গণপিটুনিতে সে মারা যায়। পরে প্রমাণিত হয়, নিহত ব্যক্তি সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিল এবং আসল চোরের সঙ্গে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী পরিবার জড়িত ছিল। একইভাবে অনেক নারী নিপীড়নের মামলায়ও দেখা যায়, প্রভাবশালী আসামিকে আড়াল করতে মূল ভিক্টিমকে উস্কে দিয়ে জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয়।

একটি গভীর উদ্বেগের দিক হলো—এই মব সন্ত্রাসে এখন শিশু-কিশোররাও অংশ নিচ্ছে। টিকটক বা ফেসবুকে লাইভে থেকে সহিংসতায় অংশ নেওয়া, হত্যার দৃশ্য ধারণ করে আপলোড করা—এটি শুধু অপরাধই নয়, বরং মানসিক বিকারগ্রস্ততার ইঙ্গিত বহন করে। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগৎ যেন এই মূল্যবোধের ঘাটতির সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা করে বসেছে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো কোথাও স্পষ্টভাবে মব সন্ত্রাসবিরোধী নৈতিক শিক্ষার কথা বলছে না।

সাম্প্রতিক সময়ের একটি বিশ্লেষণমূলক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৬৭টি মব সন্ত্রাসের ঘটনায় ৮১ জন নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নিরপরাধ। এই ঘটনাগুলোর মাত্র ১৮ শতাংশের ক্ষেত্রে কোনো মামলা হয়েছে, এবং এর মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ মামলার রায় এসেছে। বাকিগুলো হয়ত থানা পর্যন্তই থেমে গেছে, অথবা রাজনৈতিক চাপ ও সাক্ষীর অভাবে বিচারপ্রক্রিয়া আটকে আছে।

রাষ্ট্রযন্ত্র, মিডিয়া, এবং নাগরিক সমাজ এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একত্রে সোচ্চার না হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ ‘ভয়ের সংস্কৃতি’তে প্রবেশ করবে, যেখানে যে কেউ যেকোনো সময় জনতার হাতে প্রাণ হারাতে পারে—তথ্যভিত্তিক বা ভুল তথ্যে। এটি একটি সামাজিক মৃত্যু—বিচারহীনতার, অনাস্থার, এবং সভ্যতার অবক্ষয়ের মৃত্যু।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি হলো—সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ, যাতে মিথ্যা তথ্যের উৎস শনাক্ত করে কঠোরভাবে দমন করা যায়; বিচারের দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস করে দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করা যায়; এবং সবচেয়ে বড় কথা, নাগরিকদের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ফিরিয়ে আনা যায়। অন্যথায় মব সন্ত্রাস শুধু আরও ছড়াবে না, বরং পুরো রাষ্ট্রকে পরিণত করবে এক রক্তমাখা বিচারের ময়দানে, যেখানে আইন বই নয়, হিংস্রতা ও গুজবই হয়ে উঠবে নতুন শাসননীতি