শনিবার,

২৭ এপ্রিল ২০২৪

|

বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

XFilesBd

শিরোনাম

যুদ্ধ ব্যয়ের অর্থ জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবহার হলে বিশ্ব রক্ষা পেত: প্রধানমন্ত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী প্রাণি ও মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর বিএনপি নেতারা সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেওয়ার অপচেষ্টা করছে : ওবায়দুল

এলিয়টের এপ্রিলে বুদ্ধদেবের খরা: প্রসঙ্গ দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড ও তপস্বী ও তরঙ্গিণী

ড. অখিল পোদ্দার

প্রকাশিত: ১৩:৪৩, ২২ এপ্রিল ২০২৪

আপডেট: ১৮:৪৯, ২২ এপ্রিল ২০২৪

এলিয়টের এপ্রিলে বুদ্ধদেবের খরা: প্রসঙ্গ দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড ও তপস্বী ও তরঙ্গিণী

এই বাংলায় এপ্রিল এখন লু হাওয়ার সময়। অথচ নোবেল পাওয়া কবি টি এস এলিয়ট মাসটিকে দেখেছিলেন ভিন্ন চোখে। লিখেছিলেন-
April is the cruellest month, breeding 
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring 
Dull roots with spring rain.
Winter kept us warm, covering
Earth in forgetful snow, feeding
A little life with dried tubers.

এলিয়টের পিতৃপুরুষ কষ্টেসৃষ্টে খাজনা দিয়েছেন। ফসলহীনতা তখন অবিরাম। হতে পারে উত্তরপুরুষের নিরাসক্ত ব্যথার নির‌যাস এ কবিতা। আবার এমনও তো শোনা গেছে-মধুযামিনী কাটাতে গিয়ে স্ত্রী আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। বহু চেষ্টা করেও স্বামী অনুত্তেজিত থেকেছেন। সে রাতে কিংবা পরবর্তী পূর্ণিমায়ও তিনি ছিলেন নিরাসক্ত। শেষতক জানা গেছে পুরুষটি নাকি ছিলেন সমকামী! স্বামী-স্ত্রীর মনোবিবাদ মেটাতে গিয়েছিলেন তৃতীয় ব্যক্তি। শালিসের এক পর্যায়ে ভালোবেসে ফেলেন নবপরিণিতাকে। স্বামী ততোক্ষণে আরও ভেঙ্গে পড়লেন। ভর্তি হলেন সুইজারল্যান্ডের মনোবিদের স্যানাটোরিয়ামে। লিখলেন বিখ্যাত কবিতার বই-The Waste Land ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড।’ কবির স্ত্রীর নাম ভিভিয়েন। মধ্যস্থকারী বা শালিসদার ছিলেন 'বার্ট্রান্ড রাসেল।' আর হতভাগ্য পুরুষটি হলেন- টমাস স্টার্নস এলিয়ট। সংক্ষেপে আমরা তাঁকে টি.এস.এলিয়ট নামে ডাকি। যিনি কবিতার পৃথিবীকে বিশ শতকে ভেঙ্গেচুরে বদলে দিয়েছিলেন।

আমাদের বুদ্ধদেব বসু টি.এস. এলিয়টের সুরে বাংলাকে মিলিয়েছিলেন। এপ্রিল যেমন cruellest তেমনি তাঁর কাছে অভিভাবাপন্ন খরা ছিল অন্যায্য, অনাকাঙিক্ষত। ঠিক এবারকার গরমের মতোই। তপস্বী তরঙ্গিণীতে বুদ্ধদেব তাই লিখলেন-

‘অক্ষম আজ অঙ্গরাজ, বীর্য তাঁর নিঃশেষ,
শুষ্ক তাই মৃত্তিকা, রিক্ত নভোতল।’

 কিংবা-
 একই স্রোত অন্তরীক্ষে ও ভূতলে,
ঔরসে ও বৃষ্টিতে, নির্ঝরিণী ও নারীগর্ভে;
জন্ম দেয় জল, অন্ন দেয় জল, জলে জাগে প্রাণস্পন্দ ও প্রেরণা
ব্যাহত সেই প্রবাহ, আর্ত আজ নিখিল।

এলিয়টের লাইনগুলোর ভাব-স্বভাবে অনেকটাই মিল তপস্বী তরঙ্গিণীর ভাষায়। নিজের মতো করে The Waste Land এর অনুবাদ চেষ্টা করলে এমনটাই দাঁড়াবে-
(April is the cruellest month, breeding 
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring 
Dull roots with spring rain.
Winter kept us warm, covering
Earth in forgetful snow, feeding
A little life with dried tubers.)

নিষ্ঠুরতম মাস এই এপ্রিল, শুধুই জন্ম দেয়
লাইলাক মৃত জমি থেকে, মিশ্রিত স্মৃতি এবং
বাসনা, বিষন্ন শেকড়গুলোকে
বসন্তবৃষ্টির জল দেদীপ্য করে তোলে।
আমাদের ষদুষ্ণ রেখেছিল শীত, স্মৃতিহীনতার
তুষারে পৃথিবী ঢেকে, শুকনো আলুতে
খাবার জুগিয়ে ছিল সামান্য জীবন;

‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ বা পোড়ো জমির খাক মাটিতে নিরাসক্ত ফসল। দুপুরের ভাপা রোদে প্রকৃতি অস্থির। বসন্ত এসেছে। শিনশিনে পাতারা তাই দুলে দুলে বলছে সেকথা। কিন্তু ১৯২২ সালে এসেছিল ভিন্ন দুর্দশায়। টি এস এলিয়ট লিখলেন ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড।’ এর প্রথম স্তবকেই ধাক্কা দিল বরফের ওমে বেঁচে থাকা মানুষকে। সময় ও জাগরণের সঙ্গে শব্দে-ভাষায় নতুন সংযোগ ঘটলো।  জীর্ণ বিষয়ের কোলাহল থেকে বেরিয়ে কবিতা হয়ে উঠলো জ্বাজল্যমান খামারির আপ্ত বাক্য। বোদলেয়ার থেকে পল ভালেরি- সবার লেখাই ছিল তাঁর প্রেরণাশক্তি। অন্তত কবিতার বেলায় টিএস এলিয়ট একেবারেই ছিলেন ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট।’ যেমন করে ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ নাটকে বুদ্ধদেব বসু খাক মাটির গন্ধ পেয়েছেন ভিন্ন হাওয়াজলে। 

কারণ   বাংলার মানুষের মতো মুহূর্তে রূপ পাল্টানো এমন ষড়সৌন্দরয পৃথিবীর কোথাও নেই। ১২ মাসে ৬ ঋতু। যেনো বারংবার ঋতুমতি আবহমান বাংলা। সুক্ষতার সে হিসেবে এপ্রিল বা চৈত্র-বৈশাখে অস্বস্তি ছিল অবারিত । নিয়ত হুঙ্কার দিয়েও সন্ধ্যার মেঘে জোটে না কাঙিক্ষত বৃষ্টিজল। এপ্রিলের আকাশের মতোই বৈশাখী মেঘ বড্ড নিরাক। যেমনটা এবার উপলব্ধী হচ্ছে। বৃষ্টি যখন কাঙ্ক্ষিত, প্রশংসিতও বটে। যেনো যৌনহুঙ্কারের মতোই শীতল, প্রসবের মতো স্বস্তির। জলঝাপটানো স্পর্শের মতো পুলকিত এবং সর্বোপরি নিতি আনন্দের। 
বাংলার এ খরা দমাতে বৃষ্টির অনুভুতি চলবে জ্যেষ্ঠ পেরিয়ে আষাঢ় অব্দি। বানের বরষা তখন শানবাঁধানো ঘাটে। ক্রমশ: ডুবে যাবে অস্বচ্ছ সিঁড়ি। প্রকৃতির রূপ ততোক্ষণে রঙ্গ থেকে তরঙ্গে পৌঁছাবে। ভাদরে নারীর অবস্থান যেমন পিত্রালয়ে। দাবদাহ থেকে নিস্কৃতির এ এক অনন্য অনুভুতি। বৃষ্টির ফোটা যেমন শেষ রাতে ভেজায় কামিনীর পাঁপড়ি- তেমনি। বকুল, দোপাটি, দোলনচাঁপা কিংবা কদমও চেতিয়ে ওঠে। বেলির গাম্ভীর্য, কেতকীর মসৃণতা, জুঁইয়ের পুত-পবিত্র ঘ্রাণ, মালতীর নিবিড়তা আর শিউলির অলকানন্দে ভেসে বেড়াবে মনমেঘের সঙ্গী। খাক দুপুরের বিরাণ প্রকৃতি থেকে নিস্কৃতি পেয়ে গাবগাছের মিহিন পাতায় ঝিম ধরে সুতানলি সাপ। সোনাব্যাঙ উঁকি দেয় বহুদিন পর। খোঁজে দীপ্ত আভা। অতপর বীজ হারিয়ে ঘ্যাঁঙরঘ্যাঁঙ। ইতিকাফের পর এই হারানোতেই যেন সুখ। দৃশ্যহীন অনন্ত সমৃদ্ধি। বৃষ্টির আগ অব্দি খরায় নিদাঘে অস্থির মন এমনই রূপান্তরকামী। 
.

বৈশাখের আগুনে গড়া যৌবনের পরিসমাপ্তি শাওনে-শ্রাবণে। যেমন করে বৃষ্টির ফোটায় গোপনে ক্ষয়ে যায় আকাশ। থৈ থৈ মাঠ প্রাপ্তিতে ধু ধু হয় জলে। রুগ্ন ফসলের খেত মাথা উঁচু করে ক্রমশ:। ফি বছর সেরা হবে সে-বাম্পার। শুধু কি টিএস এলিয়ট কিংবা তপস্বী তরঙ্গিণীর বুদ্ধদেব? প্রত্যেক মানুষই চায় ক্ষণে প্রতিক্ষণে-এমন ভাব। পোড়োজমি কিংবা খাক মাটিতে বীজ বুনতে;  

(ড. অখিল পোদ্দার, একুশে টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক)