
কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন যে দেশে এখন ‘কৃষ্ণপক্ষ’ চলছে। দেশে সেই যে ‘কৃষ্ণপক্ষ’ শুরু হয়েছে, তা এখনো শেষ হয়নি। ‘কৃষ্ণপক্ষ’ চলছে তো চলছেই। শুধু তাই নয় ‘কৃষ্ণপক্ষের’ আঁধার আরো তীব্র হচ্ছে। কিভাবে অবসান হবে, কে অবসান ঘটাবে এই কৃষ্ণপক্ষের? এটিই এখন ইতিহাসের বড় জিজ্ঞাসা।
বিগত চার দশক ধরে যাদের নেতৃত্বে ও যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে, তাতে দেশবাসী প্রায় সবকিছুর ওপর, যাকে বলে, একেবারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে তারা মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তির দিশা ও তা সম্ভব করার মতো শক্তির পর্যাপ্ত দৃশ্যমান উপস্থিতি এখনো সেভাবে তাদের চোখে পড়ছে না। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক দৃশ্যপটে সবচেয়ে বড় সংকটটি হলো, ‘সংকট নিরসনের সম্ভাবনা দেখতে না পাওয়ার’ সংকট।
জীবন-যন্ত্রণায় কাতর দেশের শ্রমজীবী মানুষসহ জনগণের মনে নানা সূত্রে বাসা বেঁধেছে গভীর হতাশা। এই হতাশা ক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু তা এখনো স্বতঃস্ফূর্ত ও অসংগঠিত। প্রগতি ও গণতন্ত্রের শক্তি এখনো এই ক্ষোভকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সংগঠিত করে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির আকার দিতে সক্ষম হয়নি। তাই, এই হতাশা ও স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভকে বহুলাংশে কাজে লাগাতে পারছে উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তিসহ দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। ফলে দেশ সমস্যা-সংকটের আবর্তে অব্যাহতভাবে বন্দী হয়ে থাকছে। জিনিসপত্রের দাম কমার বদলে তা ক্রমাগত হু হু করে বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য আজ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন। সরকার এ ঘটনার জন্য আন্তর্জাতিক বাজারদর ও বাজার অর্থনীতির দোহাই দিচ্ছে। সরকার তার প্রতিশ্রুতি মতো রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেনি। শক্তিশালী, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত গণবণ্টন ব্যবস্থা সে প্রবর্তন করেনি। বরঞ্চ সে নিজেই বার বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেছে। পানি, গ্যাস ইত্যাদির দাম বাড়িয়েছে। অথচ গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি বললেই চলে। আয় বাড়ে ১০ টাকা, তো দ্রব্যমূল্য বাড়ে ২০ টাকা! অন্যদিকে অল্প কিছু মানুষকে বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। লুটপাট চালিয়ে সম্পদের পাহাড় বানানো হচ্ছে। সরকারের উঁচু মহলের যোগসাজশে এসব করা হচ্ছে। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, যুবক ও ডেসটিনির বাটপাড়ি, হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ভূমি দস্যুতা, চোরাকারবারির রমরমা ব্যবসা, কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি থেকে দেশে বর্তমানে কী পরিমাণ লুটপাট চলছে তার ব্যাপ্তি ও মাত্রা অনুমান করা যায়। অর্থমন্ত্রীর নিজের কথা অনুসারে দৃশ্যমান অর্থনীতির মোট পরিমাণের তিন-চতুর্থাংশই হলো তার বাইরে থাকা চোরাই কালো অর্থনীতি। অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ এখন কালো টাকার মালিক লুটেরা ধনিকদের হাতে। একদিকে অল্প কিছু মানুষের হাতে কল্পনাতীত বিত্ত-বৈভব ও অন্যদিকে দারিদ্র্যের সাগর। শুধু কিছু চুঁইয়ে পড়া ছিটেফোঁটা আসছে আম-জনতার হাতে। বাংলাদেশে এখন পৃথক দুই অর্থনীতি, দুই সমাজ, দুই দেশ তৈরি হয়ে গেছে। এসবের প্রভাবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে তারল্য সংকট, বিনিয়োগ সমস্যা, সুদের হারের অস্থিরতাসহ নানা রকমের অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে।
দেশে বড় বড় লুটপাটের ঘটনার পাশাপাশি তৃণমূল পর্যন্ত ঘুষ-দুর্নীতি, দলবাজি, তদবিরবাজি, বেপরোয়া দখলদারিত্ব, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, জবরদস্তি ইত্যাদির বিস্তার ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বেড়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি। এসবকে ভিত্তি করে ছড়িয়ে পড়েছে হত্যা, খুন,
কিডন্যাপিং, নারী-নির্যাতন, সশস্ত্র ক্যাডারবাহিনী লালন, গড ফাদারদের দৌরাত্ম্য, প্রভাব বিস্তার নিয়ে হানাহানিসহ অপরাধমূলক নানা কাজকর্ম। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হত্যা, জুলুম, সম্পত্তি দখল, ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, উপাসনালয় ভাঙচুর ইত্যাদি পরিণত হয়েছে নিত্যদিনের ঘটনায়। একই সঙ্গে অব্যাহত আছে ক্রসফায়ার-হত্যা-গুমের লোমহর্ষক সব ঘটনাবলি। মানুষের জীবনে সামাজিক নিরাপত্তা বলতে আজ আর কিছু নেই। বেডরুম থেকে খোলা মাঠ, কোথাও মানুষ আজ নিরাপদ নয়। দেশে যে ‘কৃষ্ণপক্ষ’ চলছে, এসব হলো তারই নিদর্শন।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসেবা— সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করার মাধ্যমে সমাজের বাণিজ্যিকীকরণকে সর্বগ্রাসী করে তোলা হচ্ছে। পুঁজিবাদী লুটপাটের প্রয়োজনে পরিবেশ, প্রকৃতি, প্রাণী-উদ্ভিদ জগত্— সবকিছুকেই ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। নগদ লাভের-লোভে বিনষ্ট করা হচ্ছে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের অস্তিত্ব। এই হলো ‘লুটপাটের-উন্নয়নের’ প্রকৃত চিত্র। ‘উন্নয়নের’ ফানুস উড়িয়ে জনগণকে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে। জনগণকে নির্জীব করে রাখার উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে ‘উন্নয়ন আগে, গণতন্ত্র পরে’। গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত দুর্বল করা হচ্ছে। শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করে রাখা হয়েছে। তাদের সংগ্রামকে দমন করার জন্য গঠন করা হয়েছে শিল্প-পুলিশ। ঢাকা শহর ও অন্যান্য শহরে জনসভা করার জায়গা কেড়ে নেয়া হয়েছে। মিটিং-মিছিলে চালানো হচ্ছে বর্বর আক্রমণ। গণতন্ত্র আজ খর্বিত ও আক্রান্ত। দেশে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বাড়ছে। সংবিধানকে এখনো মুক্তিযুদ্ধের ধারায় পূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই এদেশে এখনও মোশতাক, জিয়া, এরশাদের ব্যবস্থা ও ধারা বহাল রাখা হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল দুই-তৃতীয়াংশের অনেক বেশি আসন নিয়ে এখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের শ্রেণি-চরিত্র আগের মতো আর নেই। তা এখন বদলে গেছে। একসময় সেখানে প্রাধান্য ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির। আর, আওয়ামী নেতৃত্ব এখন চলে গেছে লুটেরা ধনিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে।
বাজার অর্থনীতি জন্ম দিয়েছে বাজার রাজনীতির। বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়নের খড়ের নিচে পড়ে রাজনীতি হয়ে পড়েছে রুগ্ন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লুটেরাদের মদতে ‘হালুয়া-রুটির অপ-রাজনীতির’ দাপটে ‘আদর্শের রাজনীতি’ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- এ দু’টি বুর্জোয়া দলকে কেন্দ্র করে যে দু’টি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলা হয়েছে, এই উভয় বলয়ে অন্তর্ভুক্ত শক্তি এই ‘হালুয়া-রুটির অপ-রাজনীতির’ অসুস্থ ধারাকে লালন করছে। এই দুই দলের মদতে রুগ্ন লুটপাটের-রাজনীতি আজ একচ্ছত্র প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছে। দ্বি-দলীয় মেরুকরণভিত্তিক যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশকে বেঁধে ফেলা হয়েছে তা বহুলাংশেই দেশি-বিদেশি শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফসল। পর্দার পেছন থেকে দেশি-বিদেশি শক্তি রিমোট কন্ট্রোলে দেশ চালাচ্ছে। তারা এমন একটি ‘সিস্টেম’ প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে যাতে সবসময় সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ কারণে দেশে অব্যাহত থাকছে ‘কৃষ্ণপক্ষ’।
বিপদ শুধু এটুকুই নয়। দেশে এখন যেটি ভয়ঙ্কর ‘মহাবিপদ’ তা হলো সাম্প্রদায়িক জঙ্গি সন্ত্রাসী শক্তির উদ্ভব ও বিকাশ। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িকীকরণ আজ দেশকে ধ্বংস করছে। দেশের দুটি বড় বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের পর্যায়ক্রমিক অপশাসন ও তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে। তারা দেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের ভিত্তি ধ্বংস করে এদেশকে ‘নয়া-পাকিস্তান’ বানানোর নীলনকশা বাস্তবায়নে তত্পর রয়েছে। এই ‘মহাবিপদ’ মোকাবিলায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সর্বাত্মক ‘পাল্টা আঘাত’ পরিচালনার বদলে এই দু’টি বুর্জোয়া দল তাদের ক্ষমতার সমীকরণ মেলানোর উদ্দেশ্যে এই দানবীয় অপশক্তিকে ব্যবহার করছে। বিএনপি এসব অপশক্তিকে জোটে অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে। ক্ষমতাসীন থাকাকালে সে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদেরকে তার মন্ত্রিসভায় স্থান করে দিয়েছিল। আওয়ামী সরকার নানাভাবে হোঁচট্ খেতে খেতে অবশেষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার প্রতি নমনীয়তা ও তার সঙ্গে আপোষ করে চলার পথ এই দল বর্তমানে অনুসরণ করছে। হেফাজতকে সে মাঠে নামিয়েছে এবং জামায়াত কর্মীদেরকে সাদরে দলে টেনে নিচ্ছে। তার নিজের কথাবার্তা ও কাজকর্মে ক্রমান্বয়ে বেশি বেশি করে সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটে চলেছে। ফলে, সাম্প্রদায়িক জঙ্গি শক্তির রাজনৈতিক-সামাজিক-আদর্শিক ভিত্তি দুর্বল হওয়ার বদলে তা আরো জোরদার হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এসব হলো ঘোরতর ‘কৃষ্ণপক্ষের’ প্রমাণ।
আমাদের দেশের ওপর সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ আরো বেড়েছে। নানা অজুহাতে দেশের মাটিতে মার্কিন স্পেশাল ফোর্স, মেরিন বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সর্বক্ষণ আসা-যাওয়া করছে। এভাবে এখানে তারা তাদের এক ধরনের স্থায়ী উপস্থিতি নিশ্চিত করে নিয়েছে। হানা, সোফা ইত্যাদি নানা গোপন চুক্তিতে তারা বাংলাদেশকে বেঁধে ফেলেছে। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর আনাগোনা করছে। সেখানে মার্কিন নৌবাহিনীর স্থায়ী উপস্থিতির সুযোগের জন্য তারা চাপ বাড়াচ্ছে। তেল, গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নেয়া ও অর্থনৈতিকভাবে এদেশকে শোষণের শিকলে আরো শক্ত করে বেঁধে ফেলার জন্য তারা টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করাসহ নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান ও তার গোয়েন্দা সংস্থার অন্তর্ঘাতি তত্পরতা শেষ হয়নি। ইসরাইলের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদের’ তত্পরতার খবরও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের লীলাভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। এদিকে ভারতের সঙ্গে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্তে হত্যা, সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল বিনিময়, তিন বিঘা হস্তান্তর, বাণিজ্য বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি অনেক সমস্যা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতির সুযোগে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ উস্কে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ তার ষড়যন্ত্রকে জোরদার করতে সক্ষম হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ মার্কিন-ভারত স্ট্র্যাটেজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে এশিয়ার এই অঞ্চলে একযোগে তত্পরতা চালানোর চেষ্টা করছে। সাম্রাজ্যবাদ এখন এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে তার তত্পরতার প্রধান ক্ষেত্র বানিয়েছে। বিদেশে মোতায়েন তার নৌসেনার ৬০ শতাংশ এই অঞ্চলে রাখার কথা সে ঘোষণা করেছে। ‘গণচীনকে ঠেকাও’-এর স্ট্র্যাটেজি নিয়ে সে চীনকে ঘেরাওয়ের মধ্যে রাখার কৌশল নিয়েছে। ‘সীমিত সার্বভৌমত্ব’, ‘আগাম আক্রমণ’, ‘একতরফাবাদ’, ‘রেজিম চেইঞ্জ’ ইত্যাদি নব্য-উপনিবেশবাদী নানা তত্ত্ব হাজির করে সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী তার যাবতীয় আগ্রাসী অপ-তত্পরতা চালাচ্ছে। বাংলাদেশও এসবের শিকার। দেশে এভাবে নেমে এসেছে ভয়ার্ত ‘কৃষ্ণপক্ষ’।
৩০ লাখ মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে
এদেশকে স্বাধীন করেছে। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ—এই চার মূলনীতির ধারায় দেশকে পরিচালিত করার যে স্বপ্ন সেদিন তারা দেখেছিল, তা বহুলাংশেই আজ ছিনতাই হয়ে গেছে। দেশ চলে গেছে সাম্রাজ্যবাদ, লুটপাটতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতার নিয়ন্ত্রণে। দেশের এই পরিণতির জন্য দায়ী হলো দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন এবং দীর্ঘতর সময়ের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দু’টি বুর্জোয়া দলের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের শাসন। যে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর লুটেরা ধনবাদী পথে তারা দেশ শাসন করেছে ও করছে, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো এসব সমস্যা-সংকটের ক্রমবর্ধমান বোঝা।
দেশের মানুষ নিত্যদিন নিদারুণ দুর্যোগে দিন কাটাচ্ছে। এখন তাদের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে তারা আজ পরিত্রাণ চায়। চায় ‘কৃষ্ণপক্ষের’ অবসান। এই ‘কৃষ্ণপক্ষের’ অবসান ঘটাতে হলে প্রয়োজন লুটেরা পুঁজিবাদী ধারা পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের ধারায়, তথা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে গরিব, মেহনতি ও নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের স্বার্থে দেশ পরিচালনা করা। প্রয়োজন, সেই স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নীতি আমূল ঢেলে সাজানো। অন্যদিকে প্রয়োজন বুর্জোয়া রাজনৈতিক শক্তির পর্যায়ক্রমিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশে বামপন্থি-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করা। এ কাজ একেবারে সহজ কোনো কাজ নয়। এ কাজে সফল হতে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারার ক্ষেত্রে আমূল বিপ্লবী পরিবর্তন সংগঠিত করতে হবে। এই লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হবে শ্রেণি আন্দোলন ও গণ-আন্দোলনের নতুন জোয়ার।
একথা ঠিক যে এখনই হাতের কাছে সত্, দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, বামপন্থিদের একটি কার্যকর বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ‘কৃষ্ণপক্ষের’ অবসান ঘটাতে হলে এটি অপরিহার্য। কারণ, বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প গড়ে তোলার কাজটি কঠিন হলেও তা অসম্ভব নয়। তার কারণ হলো এই যে, এ ধরনের রাজনৈতিক বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার ভিত্তি ও উপাদানগুলো দেশে বিদ্যমান আছে। তবে সেগুলো এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এসব সম্ভাব্য উপাদান ও শক্তিগুলোকে একত্রিত করতে পারলে প্রত্যাশিত সেই রাজনৈতিক বিকল্প শক্তিকে সহজেই দৃশ্যমান করা সম্ভব হবে। জনগণ শক্তিশালী বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে দ্বিধাহীন, বলিষ্ঠ ও সাহসী উদ্যোগ দেখতে চায়। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে তারা যদি অবিলম্বে এ কাজে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে না আসে তাহলে তারাও ইতিহাসের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবে।