রোববার,

১৪ ডিসেম্বর ২০২৫

|

অগ্রাহায়ণ ৩০ ১৪৩২

XFilesBd

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাছাই না হলে জুলাই আন্দোলন সুফল পাবে না

শিউলী সিকদার

প্রকাশিত: ১৩:৪৪, ২ জুন ২০২৫

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাছাই না হলে জুলাই আন্দোলন সুফল পাবে না

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়। এই যুদ্ধের বীর সন্তানরা জাতিকে উপহার দিয়েছেন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। রাষ্ট্র তাঁদের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত কোটা, ভাতা, এবং নানা ধরনের সম্মাননা ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিগত কয়েক দশকে “ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা” হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন অনেকেই, যারা কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও নানা অনৈতিক পথে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে ।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার উত্থান: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক সংগ্রাম, যেখানে লাখো মানুষ আত্মত্যাগের মাধ্যমে একটি স্বাধীন জাতির ভিত্তি রচনা করেছিলেন। সেই সংগ্রামের স্বীকৃতি স্বরূপ সরকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ধরনের সম্মান ও সুবিধা দিয়ে আসছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দেখা গেছে, অনেকেই এই সম্মান ও সুবিধা প্রাপ্তির জন্য ভুয়া পরিচয় দিয়ে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এবং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া কোটানীতি ও প্রণোদনা ব্যবস্থা।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উত্থান এক দিনে হয়নি, এটি হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের কারণে। মূলত কয়েকটি উপায়ে তারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন:

১. জাল সার্টিফিকেট ও কাগজপত্র তৈরি:
অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় অংশ না নিয়েও জাল সার্টিফিকেট ও জাল গেজেট তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বিশেষ করে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতা এই প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।

২. প্রভাবশালী মহলের সহায়তা:

বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অনুগত কর্মীদের পুরস্কৃত করতে বা জনপ্রিয়তা অর্জনের উদ্দেশ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করেছে। এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হয়েছেন এবং দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কলঙ্কিত হয়েছে।

৩. যাচাই-বাছাইয়ের দুর্বলতা ও ঘাটতি:

মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরির সময় অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক দলিল যাচাই হয়নি। বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০১০-এর আগ পর্যন্ত সময়ে বেশ কিছু “সংশোধিত” ও “সম্পূরক” তালিকায় ভুয়া নাম ঢুকে পড়ে।

৪. ট্রাইব্যুনাল ও মামলার অপব্যবহার:

কিছু ব্যক্তি ভুয়া তথ্য দিয়ে আদালতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দাবি করেছেন এবং বিভিন্ন রায় আদায় করে নিয়েছেন, যা পরে আবার রাষ্ট্রপক্ষ আপিলে চ্যালেঞ্জ করলেও প্রক্রিয়াগত সীমাবদ্ধতায় সব ক্ষেত্রে সত্য উদঘাটিত হয়নি।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ইস্যুতে জাতির ক্ষতি:

১. প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন ও অবহেলা।
২. কোটানীতি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধেই মূলত ২০১৮ সালে ছাত্র ও তরুণদের “কোটা সংস্কার আন্দোলন” গড়ে ওঠে।
৩. রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি।
৪. জাতীয় ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদাহানী।
৫. জনমনে আস্থাহীনতা ও ঘৃণা সৃষ্টি।

সমাধান যা করণীয়:

১. শক্তিশালী যাচাই-বাছাই ব্যবস্থা গঠন:
    প্রতিটি জেলার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা পুনরায় যাচাই করা দরকার, যেখানে প্রত্যেকের যুদ্ধকালীন অংশগ্রহণের প্রমাণপত্র, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য, ও দলিলাদি বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেনাবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।

২. ডিজিটাল আর্কাইভ ও কেন্দ্রীয় ডেটাবেইজ:
একটি সর্বজনীন ও স্বচ্ছ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে যেখানে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার তথ্য ও প্রমাণ সংরক্ষিত থাকবে।
জনগণ চাইলে তথ্য যাচাই করতে পারবে।

৩. ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা:
যারা প্রমাণিতভাবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
তাদের প্রাপ্ত ভাতা, জমি, পেনশন, প্রণোদনা ফিরিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে।

৪. কোটা সংস্কার ও হালনাগাদ:
মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে যেন ভুয়া লোকজন সুবিধা না পায়, সেজন্য কোটানীতিকে যুগোপযোগী ও ন্যায্য করতে হবে।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সুবিধা যেন সঠিকভাবে পৌঁছে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

৫. সচেতনতামূলক কর্মসূচি:
তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে হবে।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনাক্তকরণ ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ ও তার সৈনিকদের নিয়ে কোনো ধরনের কল্পনা বা ভণ্ডামি জাতির আত্মাকে আঘাত করে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়ন ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই কেবল “কোটা আন্দোলন” বা “কোটা সংস্কার” সঠিক পথ পাবে। মুক্তিযুদ্ধ শুধু অতীত নয়—এটি আমাদের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশকও। তাই ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করা এবং জাতির বীর সন্তানদের প্রকৃত মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়াই সময়ের দাবি।