ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক বিস্ময়কর জগৎ আছে, যেখানে স্বর আর নাদ মিলে তৈরি করে এক সুললিত অনন্ততা। সেই অনন্ততার ধারাবাহিকতাকে আধুনিক সময়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন যে সব শিল্পী, তাঁদের মধ্যে উদীয়মান সন্তুরবাদক দিশারী চক্রবর্তী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সন্তুর—নামটি উচ্চারণ করলেই কাশ্মীরের সমতল, তুষারঝরা পাহাড় আর শ্যামল স্রোতের মতো এক নির্মল সাউন্ডস্কেপ মনে ভেসে ওঠে। সেই নির্মল সুরের ভিতর দিয়ে দিশারী নিজস্ব স্বাক্ষর রেখে গেছেন—যেখানে মিশে আছে তাঁর গভীর অনুশীলন, সহৃদয়তা এবং সংগীতবোধের পরিপক্বতা। সন্তুর এমন একটি বাদ্যযন্ত্র যার নরম অথচ দীর্ঘস্থায়ী নাদকণার মধ্যে থাকে বিরাট স্পেস, অসংখ্য সূক্ষ্মতা, আর গভীর অনুভূতির প্রতিফলন। এই বাদ্যযন্ত্রকে বাজানো শুধু কারিগরি দক্ষতার দাবি করে না—প্রয়োজন হয় এক বিশাল অন্তর্গত নীরবতা। দিশারী চক্রবর্তীর বাজনায় এই নীরবতাই প্রথমে ধরা দেয়। তাঁর আলাপে মন্থরতা নেই, আবার তাড়াহুড়োও নেই। বরং আছে মিতালির মতো একটি ভরসা—যে রাগের অনুভব তিনি ফুটিয়ে তুলছেন, তা ধীরে ধীরে শ্রোতার হৃদয়ে স্থাপিত হবে।

শাস্ত্রীয় সংগীতে গুরু-শিষ্য পরম্পরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দিশারীর সংগীতযাত্রাতেও এই পরম্পরার গভীর ছাপ লক্ষ করা যায়। গুরুদের কঠোর শাসন, দীর্ঘ রিয়াজ, রাগের স্বরূপ নিয়ে ধ্যানমগ্ন অধ্যয়ন—সবকিছু মিলেই তাঁর বাজনাকে করেছে শৃঙ্খলাবদ্ধ, অথচ সৃজনশীল। তিনি জানেন—রাগ হলো একটা জীবন্ত সত্তা, যা শুধু স্বর বা নোটের সমষ্টি নয়; বরং সেই রাগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তার সময়, তার ভাব, তার স্নিগ্ধতা—সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয় একটা নিজস্ব দেহমাধুর্য। তাঁর বাজনায় এই দেহমাধুর্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। পন্ডিত দিশারীর আলাপ অংশে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় তাঁর স্বরবিন্যাসের পরিচ্ছন্নতা এবং ভাবের স্বচ্ছতা। তিনি স্বরগুলোকে তুলে আনেন এতটাই কোমলভাবে যে শ্রোতার মনে হয়—স্বর যেন নিজেরাই একে অপরের সাথে কথা বলছে। তাঁর জোড় অংশে থাকে দৃঢ়তা—একটি অনবদ্য রিদমিক প্রবাহ, যা আবার কোনোভাবেই আক্রমণাত্মক নয়। ঝালা অংশে তাঁর স্কিল ও নিয়ন্ত্রণ শ্রোতাকে বিস্মিত করে—মৃদু থেকেও তীক্ষ্ণ, দ্রুত থেকেও সংযত। পন্ডিত দিশারীর বাজনার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর নাদকৌশল। সন্তুরের প্রতিটি আঘাতে যে ক্ষুদ্র নাদকণা সৃষ্টি হয়, সেই কণাগুলোর মধ্যবর্তী নীরবতাকেও তিনি ব্যবহার করেন শিল্প হিসেবে। সঙ্গীতে নীরবতা কখনো কখনো সুরের থেকেও শক্তিশালী—এই সত্য তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। ফলে তাঁর পরিবেশনা শ্রোতাকে শুধু আনন্দই দেয় না, তাদের চিন্তায়, ধ্যানে, অনুভূতিতে নিয়ে যায়।
আজকের বিশ্বায়নের যুগে শাস্ত্রীয় সংগীত অনেক সময়ই জনপ্রিয় ধারার ভিড়ে হারিয়ে যায়। কিন্তু পন্ডিত দিশারীর মতো শিল্পীরা সেই ধারা ফিরিয়ে আনছেন নতুন প্রজন্মের কাছে। সোশ্যাল মিডিয়া, মঞ্চপারফরম্যান্স এবং বিভিন্ন সংগীতসভায় তাঁর উপস্থিতি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে নতুন করে পরিচিত করছে তরুণ শ্রোতাদের কাছে।
শুধু শিল্পী হিসেবেই নয়, একজন দায়িত্বশীল সাংস্কৃতিক দূত হিসেবেও পন্ডিত দিশারীর অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি জানেন—সন্তুরের ইতিহাস, এর সাউন্ডস্কেপ, এর আধ্যাত্মিকতা—সবই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বাজনায় তাই শুধু সঙ্গীত নয়, একটি সাংস্কৃতিক আদর্শও উঠে আসে। পন্ডিত দিশারী চক্রবর্তীর সঙ্গীতজীবন নিঃসন্দেহে দীর্ঘ পথের পথে। তাঁর বাজনায় যে পরিণত সুরভি, তা তাঁকে ভারতীয় সন্তুরবাদনের অগ্রগণ্য নামগুলোর মধ্যে স্থাপন করেছে—এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
সন্তুরের নরম মৃদু ঝংকারে যখন পন্ডিত দিশারীর আঙুল স্পর্শ করে, মনে হয় যেন সুরের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে উঠছে পর্বতের ঠান্ডা হাওয়া, নদীর স্রোত, আর মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গভীর নীরবতা। তাঁর বাজনায় ধ্বনির ভিতর জীবন্ত হয়ে ওঠে যে আত্মিক পরিসর—সেটাই একজন সত্যিকারের শিল্পীর পরিচয়।
