তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জীবনরেখা। রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও গাইবান্ধার লাখো মানুষের কৃষি ও জীবিকার মূল ভিত্তি এই নদী। কিন্তু গত দুই দশকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি প্রবাহ নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদন, পরিবেশ ও জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এর মূল কারণ হিসেবে বারবার উঠে আসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারাজের পানি প্রত্যাহার এবং যৌথ পানি বণ্টন চুক্তির অনিশ্চয়তা।

তিস্তা ইস্যুটি শুধু একটি নদীর নয়—এটি দুই প্রতিবেশী দেশের আস্থার প্রতীকও বটে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত তিস্তাসহ বেশিরভাগ নদীর জন্য স্থায়ী পানি বণ্টন চুক্তি হয়নি। ২০১১ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি তিস্তা চুক্তির খসড়া তৈরি হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তির কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তা সমস্যার সমাধান সম্ভব তিনটি বাস্তব পদক্ষেপে:
১. বর্তমান “যৌথ নদী কমিশন” (JRC) এর কার্যকারিতা বাড়ানো দরকার। শুধু বৈঠক নয়, নদীর প্রবাহ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও শুষ্ক মৌসুমের পানি ব্যবহার—সব কিছুর জন্য একটি সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠন করা যেতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের পানি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ ও স্থানীয় প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। এতে সিদ্ধান্ত হবে তথ্য-ভিত্তিক ও যৌথ স্বার্থের উপর।
২. তিস্তা অববাহিকায় যৌথ বিনিয়োগ ও উন্নয়ন প্রকল্প: চীন ইতিমধ্যে তিস্তা নদী পুনর্বাসন প্রকল্পে আগ্রহ দেখিয়েছে, তবে বিষয়টি ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে সংবেদনশীল। তাই ভারত ও বাংলাদেশ একত্রে যদি যৌথ নদী পুনর্বাসন ও সেচ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়, তবে তা হবে পারস্পরিক আস্থার প্রতীক। এতে উত্তরবঙ্গের কৃষি উৎপাদন বাড়বে, নদী ভরাট রোধ হবে এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও আধুনিক হবে।
৩. বৈজ্ঞানিক তথ্য বিনিময় ও মৌসুমি পানি ব্যবস্থাপনা: তিস্তায় বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহ এবং শুষ্ক মৌসুমে চরম ঘাটতি—এই দুই বিপরীত অবস্থা মোকাবেলায় প্রয়োজন যৌথ তথ্য আদানপ্রদান। রিয়েল-টাইম ডেটা শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে দুই দেশ আগাম পরিকল্পনা নিতে পারে। এতে কোনো পক্ষকেই ক্ষতির মুখে পড়তে হবে না।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রেখে সমাধানের পথ: তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ যদি কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে ধৈর্যের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যায়, তবে এটি দুই দেশের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করবে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ইতোমধ্যেই স্বীকার করেছে যে, বাংলাদেশের পানি নিরাপত্তা তাদের আঞ্চলিক সম্পর্কের অংশ। এখন দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি তিস্তা ইস্যুকে সংঘাত নয়, বরং সহযোগিতার সুযোগ হিসেবে নেয়, তবে এটি আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনার নতুন মডেল হতে পারে। ভারতও যদি উত্তরবঙ্গের অভিন্ন নদী অঞ্চলে যৌথ বিনিয়োগে রাজি হয়, তবে এতে দুই দেশই লাভবান হবে—বাংলাদেশ পাবে সেচ ও কৃষির স্থিতিশীলতা, আর ভারত পাবে আঞ্চলিক শান্তি ও পারস্পরিক আস্থার নতুন ভিত্তি।
তিস্তা সমস্যার সমাধান কোনো একপক্ষের একতরফা সিদ্ধান্তে সম্ভব নয়। এটি হবে পারস্পরিক বোঝাপড়া, আস্থা ও সহযোগিতার ফসল। পানি ভাগাভাগি নয়—বরং পানি ব্যবস্থাপনায় অংশীদারিত্ব গড়ে তুললে তিস্তাকে আবারও জীবন্ত নদী হিসেবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যা হবে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর একটি।
