কয়েক কর্মকর্তার একরৈখিক আচরণে ডুবতে বসেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেই কোন রিমার্কেবল থিসিস। গবেষকেরা ব্যস্ত বেতনের বাইরে আয় ইনকামে। পাল্লা চলছে, কে কার আগে কতোটুকু সুবিধা বাগাতে পারে। সবমিলে জনগণের কোন উপকারেই আসছে না ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বিশাল সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগের তির গবেষণা সমন্বয়কারী ড. মোঃ নুরুল হুদা ভূঁইয়া বরাবর।

কিছুদিন ধরেই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড নিয়ে নিবিড়ভাবে খোঁজখবরে ছিল এক্সফাইলস-এর অনুসন্ধানী দল। যা দেখা গেলো তা হলো-অধিকাংশ কর্মকর্তাই আসেন-যান রীতিতে ব্যস্ত। কাজের চেয়ে খোশ গল্প, রাজনীতি, ছেলে মেয়ের পড়ালেখা আর নিজেদের আখের কিছু হলো না এমন কথাবার্তাতেই সময় পার করেন তাঁরা। আর্থিক অনিয়মের সুতো ধরে নড়েচেড়ে বসেছে দুদক। তাদের ইনভেস্টিগেশন দল ঘুরেও গেছে বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ। যেখানে তিরের নিশানায় পড়েন নুরুল হুদা ভুইয়াসহ আরও দু’জন। তাদের দাপটে প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে শুরু করে নিম্নস্তরের কর্মচারীরাও সমীহ করে। সম্প্রতি সরকারি অডিটে বেরিয়ে আসে নুরুল হুদার আরও কিছু অনিয়ম। যার তদন্তও শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে সকল অভিযোগই অস্বীকার করেন মিস্টার হুদা। বলেন, এসব ভুয়া খবর রটিয়ে একটি পক্ষ তাকে বেকায়দায় ফেলতে চায়।

ওই কর্মকর্তা চাকরিতে যোগদান, বিদেশ ভ্রমণ এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনিয়ম করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। অসঙ্গতি রয়েছে প্রাত্যহিক নথিপত্রে। সূত্র জানায়, বিসিএসআইআর এর দরপত্র জমা দেয়ার আগেই নির্দিষ্ট চারটি প্রতিষ্ঠানকে গোপনে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। তার বিনিময়ে হাতবদল হয় মোটা অঙ্ক। গত ২৩ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির ঠিকাদারের বিষয়ে মূল্যায়ন কমিটির চূড়ান্ত সভা হয়। অথচ উক্ত মূল্যায়ন কমিটির গোপন বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবে তার এক মাস আগেই হয়েছিল। ধানমন্ডির ‘অ্যামব্রোসিয়া রেস্তোরাঁয়’ গত ২৩ এপ্রিল আয়োজিত এক ‘ইফতার বৈঠকে সিদ্ধান্তের কথা বলা। সেই গোপন বৈঠকে চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অগ্রিম সুবিধা হিসেবে ৬০ লাখ টাকা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ব্যক্তি। পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও সম্পন্ন করতে চুক্তি করা হয়েছিল। যেখান থেকে প্রায় ১ কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারার পরিকল্পনাও হয়।

বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ সূত্র বলছে, গোপন সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন টেন্ডার কমিটির সদস্য সচিব ও গবেষণা সমন্বয়কারী ড. মো. নুরুল হুদা ভূঁইয়া, ঢাকা গবেষণাগারের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. মো. হোসেন সোহরাব, ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার অ্যানালিটিক্যাল রিসার্চ (ইনারস)-এর পরিচালক ড. মো. সেলিম খান, সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার সত্যজিৎ রায় রনি, উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. বেনজির আহমেদ এবং কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি কাজী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
উল্লেখিত অভিযোগের বিষয়ে আরো জানা গেছে, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) টেন্ডার হয় ৮টি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কিন্তু যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশন এমনভাবে বানানো হয়েছিল যে, যাতে চারটি নির্ধারিত কোম্পানি ছাড়া আর কেউ টেকনিক্যাল যোগ্যতা অর্জন করতে না পারে। এটিই টেন্ডার কারচুপির পরিচিত কৌশল ‘সুবিধাভোগী বান্ধব শর্ত সংযোজন’, যেখানে দরপত্রের শর্তপত্র এমনভাবে লেখা হয়- যেনো নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কেউ অংশ নিতে না পারে।
শুধু তাই নয়, পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের মদদপুষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘ দিন ধরে নিয়োগ বাণিজ্য, ঠিকাদারীসহ বিভিন্ন সেক্টরকে জিম্মি করে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটিপতি বনে গেছেন। সেই চক্রটি এখনো বহাল রয়েছে। আর এই চক্রেরই হোতা হিসেবে উঠে এসেছে নুরুল হুদাসহ তিনজনের নাম।

সম্প্রতি আরেকটি অভিযোগ বেশ তোড় পাকাচ্ছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে ২০ বছর ধরে সরকারি চাকরি করছেন নুরুল হুদা। ক্রমশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের দেয়াল টপকে এ খবর পৌঁছে গেছে সাংবাদিকদের কাছে। এমনকি তিনি ঐ হিসেবে সুযোগ সুবিধাও ভোগ করছেন। এই অনৈতিকতার প্রভাব পড়েছে পুরো অফিসে। জুনিয়ররাও কাজে ফাঁকি দিয়ে বাড়তি ফায়দা লোটায় ব্যস্ত হয়েছে। কর্মচারীরা তো ফাইল ওয়ার্ক করতেই চান না। ক্রমশ এক আজব অফিসে পরিণত বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ। নুরুল হুদা ভূঁইয়ার প্রভাব এতটাই বিস্তৃত যে, বিসিএসআইআরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিম্নস্তরের অনেক কর্মচারীও তার ভয়ে তটস্থ। ২০০৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিসিএসআইআর- এ যোগদান করেন। জুনিয়র হয়েও বিসিএসআইআর আরসি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। কেনাকাটাসহ বিভিন্ন অনিয়মের সাথে তখন থেকেই জড়িত। বিসিএসআইআরের উর্ধতন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে অপরাপর তদন্ত রিপোর্টগুলো হাতে পেলে বিশদ অনুসন্ধান আমরা জানিয়ে দিব।
