
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নেপাল এক নজিরবিহীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়। রাজধানী কাঠমান্ডু সহ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সহিংস বিক্ষোভ, কারফিউ, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা এবং সেনা টহল। এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তরুণ প্রজন্ম—যারা নিজেদের “Gen-Z” নামে পরিচিত করে তুলেছে। তারা সরাসরি প্রশ্ন তুলেছে সরকারের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার দমন নিয়ে। এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ভিডিও ভাইরালের মাধ্যমে, যেখানে দেখা যায়, নিরাপত্তা বাহিনী এক তরুণকে অমানবিকভাবে নির্যাতন করছে। এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই নেপালের তরুণ সমাজ ফুঁসে ওঠে। তারা রাস্তায় নামে, প্ল্যাকার্ড হাতে ধরে “Enough is Enough”, “No More Silence” ইত্যাদি স্লোগান। খুব দ্রুতই এটি একটি সংগঠিত গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
নেপাল সরকার প্রথমদিকে আন্দোলন দমন করতে কঠোর অবস্থান নেয়। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়, TikTok ও অন্যান্য অ্যাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে আন্দোলন দমে না গিয়ে আরও উগ্র হয়ে ওঠে। পুলিশের গুলিতে কয়েকজন আন্দোলনকারী নিহত হন, যা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে।
এরই মাঝে প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলি সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে মাঠে নামানো হয় এবং রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে। প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান নিয়ে নানা জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে—তিনি কোথায়, কী করছেন তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। পরে জানা যায়, তিনি কাঠমান্ডুর কাছে শিবপুরি পাহাড় এলাকায় সেনাবাহিনীর একটি দুর্গে আশ্রয় নিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মহলও উদ্বেগ প্রকাশ করে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেপাল সরকারের প্রতি শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানায়। চীন, যা নেপালের দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অংশীদার, নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে কিন্তু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
এই আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো—এটি ছিল মূলত নেতৃত্বহীন, ডিজিটাল-নির্ভর, এবং আত্মপ্রবঞ্চনাহীন এক জেনারেশনের কণ্ঠস্বর। তারা রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য নয়, বরং নিজেদের অধিকার এবং স্বচ্ছ শাসনের দাবি নিয়ে রাজপথে নামে। একে কেউ কেউ ‘নেপালের আরব বসন্ত’ বলেও অভিহিত করছেন।
বর্তমানে, পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও সরকার এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, নেপাল এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে—যেখানে তরুণরা শুধু ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানে নেতৃত্বের দাবিদার।
এই আন্দোলন কেবল নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই নয়, বরং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রজন্মের মনস্তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তার প্রতিফলনও বটে।