
ড. অখিল পোদ্দারের দীর্ঘকবিতা
অধুনা চর্যাপদ
( চর্যাপদ-১ )
বর্ধিষ্ণু গ্রাম, হাজারো মানুষ,
অথচ-
একখানি খাটিয়া
চষে বেড়ায় গ্রাম থেকে ভিঁনগাঁয়ে
( চর্যাপদ-২ )
আসেন কত্তা নেমন্তন্ন খায়
শাদা বক চড়ুই কিংবা অজানিত পোকপাখাল
সঙ্গে আনতে ভুলবেন না রাতের কৃত্রিম জোনাকি
ঝাড়কচু, পিঁপড়ার ডিম, বনকাঁঠালের বাদুড়
যে প্রাণীরা আসতে চাইবেন
আসুক সবাই আলো হাতে;
বড় লাট, কর্ণওয়ালিস, মানসিংহ কিংবা ইব্রাহিম লোদী
পানিপথের যোদ্ধাগণ
সবাই সেদিন আমার কত্তা-
ভুলবেন না কিন্তু;
( চর্যাপদ-৩ )
বক্তব্যের প্রথম প্রহর বিদ্যমান
মাঠের মানুষ, জাদুর শহর ভেজায় প্রস্রাব ও ঘামে
নেতার মাথায় ধান দুব্বা
পুডছে পুডুক রমনার ডাল
বান্দির শাড়ি, ভৃত্যর জামা
তার চেয়েও ঢের বেশি
শহর জুড়েছে
অন্নদা ঘোষের মামা-
সে কি-না বদলায় দল, বদল হয় মোমবাতি
হাড় জিহ্বা মেরামত করে জন্ম দেয় পুরোন মানুষ
মাগধি রাজার কুরসির মতো
সদরঘাটের লঞ্চ ভেঁড়ে চাঁদপুর বন্দরে;
( চর্যাপদ-৪ )
তরবারি রেখে গেছে স্মারক
লক্ষণ সেনের উত্তরপুরুষ
পালিয়েছে নবদ্বীপের সন্যাসী
সাক্ষী সবে তিন পাহাড়ের স্রোত।
এসো গগনশিরিষ, এসো মেঘদল পাখিরা
চলো বাসা বুনি বাবুই মনাদের টিনের চালে
যুদ্ধ অনিবার্য হলে
বৃথা যায় তরবারি স্মারক
বরং খোল করতাল সম্মিলনে
দূরের শ্মশান চলে আসে নিবির নৈকট্যে;
( চর্যাপদ-৫ )
আসেন কাকা তাবিজ নেই
আপনার তো জন্ডিস আছে
ডাবপড়ায় কাজ না হলে
মাটির মালসায় ঢালবেন রতিবত্তাসার।
অষ্টধাতু নিপাত গেছে দ্বাপরযুগে
আপনার চোখের পিচুটি বলে শ্বেতী রোগের লক্ষণ
বাড়ির বাম দিকের উত্তর কোণে লেগেছে বাঁও বাতাস-
কাকা আপনার তাবিজ প্রয়োজন।
সুদ হারাম কিন্তু শুভযোগ ছাড়ে না আপনার মাইক্রো-ইকোনমি
বাতের ব্যাথায় জ্বরজ্বর আপনি
না করেন না শুধু প্রজাতিরক্ষায়
লাল সুতো, উলের মালা
শব্দের আগে ফেটে পড়া আতশবাজির গুপ্ত আয়োজন
সত্যি কাকা, আপনার তাবিজ প্রয়োজন;
( চর্যাপদ-৬ )
মনের গ্রামে দুটি পাড়া
চোর ডাকাতে সমান-সমান
আলিবর্দি খাঁ করেন শাসন
বদনাচোরের চুল যে ন্যাড়া।
সিঁদ কেটে সে পান্তা খেতো
জালাল রুমির খানকা ঘরে
কী বলবেন সম্রাট এবার
শোষণ শাসন বিচার পরে?
ধুতির তলে গামছা রেখে
গরুর রাখাল দস্যু রতন
ফল খেয়েছে জলের নিচে
উপোস করেন অসুর যেমন।
মন জেনেছে সেসব খবর
মন মজেছে বাজার-ঘাটে
মুর্খগণ্ড রাজারপাগল
প্রজার নাকি মান ভেঙেছে।
মনের গ্রামে দুটি পাড়া
সত্য-মিথ্যা দামে চড়া
নিন-না মশায় বাজার দরে
সিঁদ কাটা সে ক্ষুধার্তকে
রাজার যদি মান ভেঙে যায়
কুড়িগ্রামে রাজারহাটে;
(১৪ জুলাই ২০২৫, পুকুরপাড়, কলাবাগান, ঢাকা)
( চর্যাপদ-৭ )
খাতা কেটে বানালাম ঘুড়ি
ঘুড়ি গেলো শশুরবাড়ি
মেঝোশাশুড়ির টিয়েটা
ছোট শ্যালিকার বিয়েটা
আমিই ভেঙেছি-
সেই থেকে
বন্ধ গেছে ও-বাড়ির কপাট
তাতে সন্যাসী হতে পারিনি
কৌপিনধ্বজা হয়ে জন্ম দিয়েছি
মেঘদঙ্গল পাখির নীড়
ওদের ঘর ছিল টিলার ওপর
উড়ে এসে তারাই হয়েছে স্মিত আকাশ
কিংবা
নাটাইছেঁড়া সন্ধ্যাকাশের ঘূর্ণি;
(১৪ জুলাই ২০২৫, পুকুরপাড়, কলাবাগান, ঢাকা)
( চর্যাপদ-৮ )
এ-ও কী কপালে ছিল রে বিধি
মেঘ হয়ে ফিরে আসবো বৃষ্টির ঘরে
শুষে নেবো স্নিগ্ধজল
নির্গত পাখার বাতাস প্রেয়সীর হাতে
ফণা হয়ে ফিরে আসে
লোলুপ জিহ্বার উত্তর নিস্ফল;
যে পাখি ওড়বার আগে-
নিশ্বাসে মেখে নেয় পড়ন্ত উড়োপ্লেন
দম নিতে নিতে মাদ্রাজি মেঘ
মুহূর্তে-
রোদেলা দুপুর ভাসে নীড়ের হাওয়ায়
এ-ও কি কপালে ছিল সমূদ্রকন্যা?
মেঘ শুধু ফিরে গেছে একাকী নিরব
বহুদেশ ঘুরে বহুক্রোশ দূরে লুপ্ত সে নিধি;
( চর্যাপদ-৯ )
বৃষ্টির রাতগুলোতে
শুকনো পথ আছেড়ে পড়ে
পথিকের কোলের ওপর।
যে নদে মরে যতোবার
মানুষ নয়, পাটনি যে সবার
পিছলাঘাটে আছাড় না খেলে
শ্যাওলায় ছেয়ে যাবে শান বাঁধানো শরীর।
( চর্যাপদ-১০ )
লাল কাপড়ে জড়ানো হাঁড়ির ভেতর
ক্রমশ গলতে থাকে লোভ
এক জন্মে একক পাতিল
পোড়ায় যেমন শত মনের ক্ষোভ;
গলিত লালা কিংবা বিশুদ্ধ বাষ্পজল
দন্তকারুকার গেছেন তুলির আঁচর আনতে-
ও বাড়ির বৃহত্তম জীবন যেনো উনুনের ধুম
সবাই গলে গেছে উন্মত্ত পাতিলে
কামুকের ঘ্রাণটুকু লাভার মতো
লাল সালুতে বাঁধা প্রকান্ড পাতিল
হোমযজ্ঞে বিরিয়ানির যতো
ডেকচি বন্দি আস্ত এক জীবন;
( চর্যাপদ-১১ )
ঘ্রাণ শুঁকলে গলে যায় নিষিদ্ধ লোবান
এক মানুষের এ জীবন পাল্লার একক
অস্থি মজ্জা বায়ুতে
স্যুয়ারেজের সব নালা
বুড়ি হবার আগে মিশে যাবে গঙ্গায়।
বিকট স্নেহ, নীড় পোড়া মেঘ
কিংবা
তুরাগের স্নেহমাখা গন্ধযুক্ত পানি
শতেক সমারোহে
শরীর মেখে নিবে রত্নগর্ভ ঢাকা
কলকব্জা আর আরোগ্যসদনের বর্জ্য;
এসো ধান-পাতিলের পাখি
কিচিরমিচির বুনো মাঠ
শিরিষ শৈবালে বড় হওয়া
পুত্রের বুনন বীজ-
পতিত জমি রইলো নিরাক
খৈ-ফোটা রোদে দাহকালের মাঠ।
এও জানি-
সবাই ফিরে পাবে সখ্য নীড়,
তপ্তরোদে শোধন হবে বটতলা
শুধু রয়ে যাবে নিঃশ্বাস ও প্রাণের পরম্পরা;
(২১ ডিসেম্বর ২০২৪, পুকুরপাড়, কলাবাগান, ঢাকা )
( চর্যাপদ-১২ )
যদি এমন হয়-
যাও পাখি বলো তারে
সে যেনো ভুলতে পারে,
সহসা সবিশেষ-
যদি কি-না আসিবারে চায়
উড়ে উড়ে স্নিগ্ধ হাওয়াই
ডানা তার পরিমিত কল্পনা।
চোখের সুরমায় নিগুঢ় স্রোত
আগুনমুখোর নির্বাক ভেলায় বসে
কাক বলে, ডাকো চড়াই
এ শহরে-
নীড়ে ক্ষীরে যে জন মেশায়
সে জীবন তো বিফলে যায়
(২২ ডিসেম্বর ২৪ পুকুরপাড়, কলাবাগান, ঢাকা)
( চর্যাপদ-১৩ )
বিষপূর্ণ হাটে এসে সবাই কিনছে
তামাক পাতা গুল জর্দা আর খৈনে সমাহার
অথচ-
এক সত্ত্বা অপরকে বলছে টক্সিক মানুষ!
সেই যে বিস্তির্ণ খেত ভর্তি অক্সিজেন বীজ
হাওয়ায় মিশে আছে দমযুক্ত আদম
চক্র যার অযোনিচক্রে
রুদ্ধ যাত্রাপথে অসংখ্যা ইজি-বাইক
বক্ষব্যাধির নন্দিত চিকিৎসক
বিদেশ সেমিনারে বহুদিন
তারচে বরং নিস্ফলা মাঠ ভালো
নইলে হবে অরণ্য রোদন
রোদ্রতাপে নিঃশেষ প্রায় দমযুক্ত আদম।
যেখানে নির্বাণ হয় হলুদ পাখির দল
বক আর বাদলের ছানা
নিমিত্তে নন্দিত সে জন
ধুলো স্বর, রুক্ষ দেহ কিংবা দেবদারু গাছ
আসরে বন্দি সরু সব দৈত্য-দানব
বিষপূর্ণ হাটে এসে যৌবনগলিতে
খসে যাবে নীল, পলেস্তরা ধ্বসে যাবে
অলীক মেঘের অদৃশ্য অমৃতে।
শুষে নিও কাল
অকালের বৃষ্টি
মাটি ফেটে যাবে
নিমিত্তে যে জন
তবে তাই হোক তামাকপাতার সঞ্চারি
আদিগন্ত বকের স্নেহবদ্ধ সারি
দোল খায় সবুজ, নড়ে বসে
বিষ-ভাণ্ডারে মানব অসুখ;
(২২ ডিসেম্বর ২৪, পুকুরপাড়, কলাবাগান, ঢাকা)
( চর্যাপদ-১৪ )
বনেদী আসবাব কাছে না টানলেও
শোবার খাট যেনো মৃগি রোগীর মতো
অস্থির সময়কে উপেক্ষা করে
এক্সেলেটর সিঁড়ি যেমন
থেমে থাকলেও মানুষকে পৌঁছে দেয় গন্তব্যে।
বিষকে বড়ি ভেবে খেলে
কখনো তা কাজ করে না
চিরল পাতায় আঁকা সবুজ ভারি
মিহিন শিরায় মিশে রবে অক্ষবাট
বৈদ্য শান্তি কবিরাজ বটে
মরা ডালে বসে না শুক-সারি;
সুতানলি ঢেউ
গাবগাছের চিরলপাতায়
গায়ের ঘ্রাণে মোহিত মা পাখি
সে ডালে জগডুমুরের গল্প
নিরন্ন ওষুধ ভেবে খেয়েছেন ঈশ্বর।
(১৪ জুলাই ২০২৫, পুকুরপাড়, কলাবাগান, ঢাকা)
( চর্যাপদ-১৫ )
চিটায় ভর্তি তৈমুর লংয়ের মাঠ
মাঝ আকাশের মরা গাছটি
বাষ্পহীন মেঘের কুয়াশায়
কুঁচকে গেছে ভ্রু।
এসো কৃষাণী, রানীভবানী
চৈতালি কুলায় তোলো ভবিষ্যতের বীজ
হিমের রাতে পঞ্চগড়ে
পাকপান্জার করুণ সুরে
পাথালভেদী কৃষক এবার
ফসলজুড়ে অন্তসলিল
মহারণে যজ্ঞ করা শত্রুঘ্ন ঈমান আলী
সবার ডালে সুখের পাখি সতত সে নিরবধি।
নলখাগড়ার নাড়ানূরী
চাঁদের ঘরে ঝলক চুরি
জিতবে আকাশ, মাঠের সবুজ
দর্জি মেশিন গোপন নিধি।
পায়ে হাঁকো নিরাক ধুলো
সড়ক বাতি স্বস্তি ছড়ায়
আলোয় গেছে আলোর কাছে
শ্রদ্ধা-ঘ্রাণে তনুমনে
উড়াল দেহে গুপ্তমাটি ।
(১৩ জুলাই ২০২৫, পুকুরপাড়, কলাবাগান, ঢাকা)
( চর্যাপদ-১৬ )
এ মাঠে কোন মরা গাছ নেই
বিস্তর জুড়ে
শব্দসুরে শুধু গান আর গান
তাই দেখে বিশ্বব্যাংক
সমৃদ্ধির পাঁচালি খোঁজে ভিয়েতনামের সেমিনার।
উচ্ছ্বাস করে নলখাগড়া, নাড়ানূরী গম-খেসারি
এসো প্লাবন, মধুবন্ত নদ আর সবুজ পাতার কবি
জেগে ওঠো মেশিনের মতো-
দর্জি যেমন
কড়কড়ে আওয়াজে ওঠায় পায়ের কাঁপনে।
(১২ জুলাই ২০২৫, পুকুরপাড়, কলাবাগান, ঢাকা)
( চর্যাপদ-১৭ )
সঙ্গমমুহূর্ত যেন কারুকাজ নিশ্বাসে
বামরুনগ্রাদ পোড়ে নিদানের কালে
নির্জিব কার্ডিওগ্রাম
স্রোতস্বতী মেঘ, প্লাবনজুড়ে ঘুঙুর বাঁধা নাম না জানা চিল
উইকেন্ডের রাতে-
বিচ-পাড়ে মিয়ামির শোভিত স্যাম্পেন
বিবর্তিত রমণির ঘরে ম্যাকডোনাল্ডের ঘ্রাণ।
মন তুমি হে নিশিচোর-
নিশুতি রাতের লংআইল্যান্ড,
কিংবা
হার্ভার্ড উঠোনের স্নেহসবুজ ঘাস
লাল-পার্পেলে যীশু হাঁটেন নিশ্চয়
খোদাই পাথর ক্ষয়ে
রয়ে যায় টর্ণেডো।
যেদেশে বাতাস ভেজায় মাটি
খিলকা পরা অস্থির মানুষ
গতির সান্নিধ্যে
কুরুশবিদ্ধ মোমবাতি
কিংবা পালিত দেবদারু,
অন্তিম পরম্পরায় গলে যায় বিমূর্ত লোবান
নিস্ফলা মাঠে শুধু দোলে বীজপাতা
নারীর পেটক্ষেতে;
(১২ মে ২০২৩, একুশে টেলিভিশন, কারওয়ানবাজার, ঢাকা)
( চর্যাপদ-১৮ )
অন্তসলিলা শস্য
আবরণকামী পতঙ্গ
সহসা সবুজ দৃষ্টিসীমায়
কেবলই পুরুষের উত্তম পরম্পরা-
মোরাকাবার ঘরে,
অদৃশ্যের নেহার বটে তুমি
ভালোবাসা নিও, নিশ্চুপ দেনমোহর;
(১০ মার্চ ২০২৪, একুশে টেলিভিশন, কারওয়ানবাজার, ঢাকা)
( চর্যাপদ-১৯ )
খারাপ মনে হলেও আপাতত
দেশির চেয়ে দুধেল গাইয়ের
বেড়েছে চাহিদা
প্রতিসেরে ৪০ এর ওপর
সরবতের চেয়েও ঘন নহর।
লোকসান মনে হলেও আপাতত
যোগান বেড়েছে রঙিন টমেটোর
স্প্রে সাবান স্যানিটাইজার
সেনশেসন সবই মুখোশের মতো
মুগ্ধ নাক গুণে চলে সিদ্ধ কাম
চোখের পলকে
হাইব্রিড লোবান বীজ
করোনায় বন্দি জবা ফুলের ঘ্রাণ।
শুনেছি বেড়েছে চাহিদা
গঞ্জের হাট থেকে জেগে ওঠা চরের বালুগাঁয়
সেরপ্রতি ৪০ মন
টিসিবির ট্রাক, ভিজিডির নোট
মেন্বারের তোষক চেয়ার
বাড়েনি শুধু রাস্তার পাশে
বস্ত্রহীনা হাফবেশ্যার কদর;
দিনে যে ফেরিওয়ালা
রাত হলে
ভদ্রলোকের শরীরচাদর
জুবুথুবু শীত যায় বছর বছর
আসবে তো !!!
(১৭ মে ২০২৪, একুশে টেলিভিশন, কারওয়ানবাজার, ঢাকা)
( চর্যাপদ-২০ )
কুত্তাকে তাও মানুষ বানানো যায়
কিন্তু মানুষকে?
না হয় সে তো বন্দি বানর
অহর্নিশি ক্লান্ত প্রহর
তবেই কি-না ত্যাগী কুকুর !