
শহীদ আল বোখারির দর্শন: আত্মোপলব্ধির পথে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণ, নৈতিক শিক্ষা এবং সচেতন সমাজগঠনের আন্দোলনে শহীদ আল বোখারি এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী মহাজাতক নন—একজন দার্শনিক, একজন চিন্তানায়ক, একজন সংগঠক এবং সর্বোপরি আত্ম-অনুশীলনের একজন আধুনিক সাধক। তাঁর নির্মিত দর্শন আধুনিক বিজ্ঞান, প্রাচ্য আধ্যাত্মিকতা এবং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে। এই দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি সাদামাটা কিন্তু বিপুল অর্থবহ বাণী: “ভালো মানুষ, ভালো দেশ, স্বপ্নভূমি বাংলাদেশ’’।
এই মূলমন্ত্র কোনো আদর্শগত অলংকার নয়; এটি একটি যুগান্তকারী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র, যা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়। শহীদ আল বোখারি মনে করেন, ব্যক্তি যদি নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারেন—তবে সমাজ ও বিশ্বের পরিবর্তন অনিবার্য। এই ধারণা থেকেই গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম মেথড তথা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন-যা একটি ধ্যানকেন্দ্রিক মনোশক্তি ও আত্ম-উন্নয়নমূলক অনুশীলন পদ্ধতি লাখো এবং এটি ইতোমধ্যে অগণিত মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আত্মউন্নয়ন সাধারণত পুঁজিবাদী কোচিং, মার্কেটিং বা ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু শহীদ আল বোখারির মানবিক দর্শন সমস্ত কূপমন্ডুকতা ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে- নিগুঢ় আত্মিক বিপ্লবের হাতছানি দেয়। যেখানে রয়েছে পরিশুদ্ধতার সন্ধান, শতভাগ সেবার মানসিকতা, কায়মনে কৃতজ্ঞতা, ক্ষমাশীলতা আর জগত সংসারে থেকেও ধ্যানের মাধ্যমে অনন্তকে জয় করার ব্রত।
কোয়ান্টাম নির্বাহী মহাজাতক শহীদ আল বোখারির দর্শনের ভিত্তি মূলত চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে।
১) আত্মজ্ঞান,
২) আত্মশাসন,
৩) সেবাব্রত এবং
৪) সামষ্টিক কল্যাণ।
এই চার স্তম্ভ সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলে একটি নতুন ধরণের নেতৃত্বের দর্শন—যেখানে নেতৃত্ব মানে ক্ষমতা নয়, বরং দায়িত্ব।
শহীদ আল বোখারির কোয়ান্টাম দর্শনে মন একটি সাধারণ শক্তির সূচক মাত্র। এটি সূক্ষ্মতর স্তরে বিশ্বজগতের সঙ্গে যুক্ত। এমন চিন্তার উৎস খুঁজে পাওয়া যায় সুফি দর্শন, উপনিষদের ব্রহ্মজ্ঞানের ধারণা, বৌদ্ধ চিত্তানুশীলন ও আধুনিক নিউরোসায়েন্সের গবেষণায়। শহীদ আল বোখারি বলেন, “মনের অন্ধকারই আমাদের জীবনের অন্ধকার তৈরি করে। মনের আলোই আলোকিত করে জীবন, সমাজ, জাতি।” এই মনের রূপান্তরের জন্যই তিনি তৈরি করেছেন মেডিটেশনভিত্তিক কোয়ান্টাম প্র্যাকটিস। ইতোমধ্যে কোয়ান্টাম মেডিটেশন এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে প্রায় প্রতি মাসেই চারদিনের লম্বা কোর্স করছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার হাজারো মানুষ। কেউ কেউ এ প্রগ্রামগুলো রিপিটও করেন। কারণ তাঁর লম্বা বক্তব্য ও ক্লাসগুলো এতোটাই প্রাঞ্জল ও সুন্দরতম যে, পিতপতন নিস্তব্ধতায় সিনিয়র সিটিজেন ও শিশু কিশোরেরা তা যারপরনাই জ্ঞান দিয়ে উপভোগ করেন।
শুধু দর্শন নয়, শহীদ আল বোখারির জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগই এই দর্শনের বাস্তব প্রয়োগ। রক্তদান, চোখদান, দুঃস্থদের সেবা, পরিবেশ সচেতনতা, নারীদের আত্মনির্ভরতা, মেডিকেল ক্যাম্প, ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাসেবার মতো সামাজিক উদ্যোগ কোনো আলাদা দাতব্য প্রকল্প নয়, বরং তাঁর সমগ্র দর্শনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তিনি মনে করেন, সেবা না থাকলে আত্মিক উন্নয়ন অসম্পূর্ণ।
তাঁর চর্চার মধ্যে আছে গভীরভাবে শৃঙ্খলিত জীবনযাপন। “আত্মশাসন”-এর ওপর তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। তাঁর ভাষায়, “যে নিজের ঘুম, খাবার, কথা, রাগ, বাসনা—এই পাঁচটি বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে, সে-ই প্রকৃত মানুষ।” এই কঠিন আত্মশাসনকেই তিনি সাধনার প্রকৃত রূপ বলে মনে করেন।
শহীদ আল বোখারির ক্লাস করলে বোঝা যায়—তিনি একজন অতি প্রাজ্ঞ চিন্তাশীল মানুষ, যিনি সময়কে গভীরভাবে পড়েন, সমাজকে বোঝেন এবং সেই অনুসারে দিকনির্দেশনা দেন। তাঁর এক বিখ্যাত উক্তি:
“আমরা যদি ভেতরের বিপ্লব না ঘটাতে পারি, বাইরের কোনো বিপ্লব স্থায়ী হবে না। আসল বিপ্লব মানুষের ভেতরে, চেতনায়, অন্তরজগতে। সেখানে পরিবর্তন ঘটলেই সমাজ পাল্টাবে।”এই চেতনার আলোকে তাঁর কিছু শিষ্য ও অনুগামীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরা যায়, যা এই দর্শনের কার্যকারিতা ও গভীরতা ব্যাখ্যা করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী সাইফ ইসলাম দিলাল যিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সুপরিচিতনাম। পেশায় সাংবাদিক হলেও তাঁর নেতৃত্বে রয়েছে একাধিক পেশাজীবী সংগঠন। কথায় কথায় সাইফ ইসলাম দিলাল বলছিলেন-
“আমি কোয়ান্টামে যোগ দিই ২০০৯ সালের দিকে। জীবন তখন অনেক বিষন্ন হতাশা আর আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভরা ছিল। কোয়ান্টামের ধ্যান, কৃতজ্ঞতার চর্চা আর শহীদ আল বোখারির কালামগুলো আমাকে নতুন জীবনবোধ দেয়। তিনি আমাদের শেখান—‘তুমি নিজেকে ভালোবাসলে, তবেই তুমি অন্যকে ভালোবাসতে পারবে।’ আজ আমি একজন সফল পেশাজীবী, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা—আমি একজন ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টায় আছি।”
রূপালি ব্যাংকের আইন উপদেষ্টা শারমিন লিপির অভিমত,“কোভিড-১৯ এর সময় আমরা যারা কোয়ান্টামের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তারা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্তদান চালিয়ে গেছি। কারণ শহীদ আল বোখারি আমাদের শিখিয়েছেন, সেবাই সাধনা। তিনি শুধু একজন নেতা নন, তিনি আমাদের চেতনার জাগরণ ঘটিয়েছেন।”এমন কথাই বলেছেন বাংলাদেশের ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক মেহেদী হাসান।
মূলত: শহীদ আল বোখারির দর্শনের সঙ্গে কিছু আন্তর্জাতিক চিন্তাবিদের তুলনা করা যায়। যেমন, ভারতের শ্রীশ্রী রবিশংকর, আমেরিকার টনি রবিনস বা ডিপাক চোপড়ার দর্শন আত্মোন্নয়ন ও চেতনা জাগরণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও, শহীদ আল বোখারির দর্শনের ব্যতিক্রম হলো—তিনি একইসাথে দর্শন, সামাজিক বাস্তবতা ও সেবার মাঝে এক সরল কিন্তু গভীর সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তিনি বিশাল পুঁজির সহায়তায় কোচিং সেন্টার করেননি, বরং নিজস্ব দর্শন, নেতৃত্ব ও চিন্তাশীল কর্মপন্থার মধ্য দিয়ে এক বিকল্প সচেতনতা তৈরি করেছেন। ভারতের সদগুরু জগ্গী বাসুদেবের দর্শনের সঙ্গেও তাঁর জীবনাচারে রয়েছে অনেকটাই মিল। তবে এটি সত্য যে, সরাসরি লালনের দর্শনের ভাবালুতা তিনি গ্রহন করলেও অধ্যাত্মবাদের নিগুঢ় তত্ত্বগুলো পীর আউলিয়াদের মতো সামনে আনেননি। কিছুটা গোপন রেখেছেন। তাঁর ক্লাস ও সেমিনারে এসবের ছায়া রয়েছে মাত্র। লালনপন্থিরা যেভাবে সরাসরি বলেন তিনি তা করেন নি। ভাবে ও ভাষায় জীবন ও প্রাণের বেড়ে ওঠাকে গুরুত্ব দিলেও অধ্যাত্মবাদের ঝাঁপি অনুরাগীদের সামনে খুলে দেননি। সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিশে মানবতাবাদ ও সর্বপ্রাণবাদের অর্ঘ বিতরণ করছেন।
তাঁর লেখালেখি ও ভাষার শক্তি: শহীদ আল বোখারির ভাষা সরল কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর রচনায় দার্শনিক গভীরতা ও মানবিক আবেগ একত্রে বিরাজ করে। তিনি প্রায়ই বলেন, সাফল্য তোমার লক্ষ্য নয়, অবদান হওয়া উচিত তোমার লক্ষ্য। এভাবে প্রতিদিনের জীবনাচরণে যা যা দরকার তারই সবই তিনি পুস্তকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। সবমিলে একশ’র উপরে রয়েছে তাঁর প্রকাশনা। এই বিভাগটি এতোটাই বৃহত্তর কাজ করে যাচ্ছে যে, আগামী এক দশকে সমাজদর্শনের এক অনন্ত ভাণ্ডার উপহার দেবে। তাঁর লিখিত ও বক্তৃতাভাষ্যে “মন নিয়ন্ত্রণ”, “আত্মশক্তি”, “চেতনা বিপ্লব”, “আলোকিত সমাজ”—এই চারটি শব্দ বারবার ফিরে আসে। এতে বোঝা যায়, তিনি কেবল তথ্য নয়, বরং অভ্যন্তরীণ উপলব্ধিকে ভাষায় রূপ দিতে জানেন।
এই সময়ে, যখন আমাদের সমাজ আত্মঘাতী রাজনৈতিক দোদুল্যমানতায়, তরুণ প্রজন্ম আত্মবিভ্রান্ত ভোগবাদের ধুয়োতে, ধর্ম ধর্মান্তর নিয়ে সংঘাতে, সেখানে শহীদ আল বোখারির দর্শন একটি বিকল্প জাগরণের সংকেত। তাঁর দর্শন বলিষ্ঠ, কারণ এটি পরম্পরার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু পরম্পরার অন্ধ অনুসরণে আবদ্ধ নয়। এটি প্রাচ্য আধ্যাত্মিকতাকে সম্মান করে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োগও আত্মস্থ করে। শহীদ আল বোখারি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন—প্রকৃত মুক্তি বাইরে নয়, ভেতরে। ধর্ম, রাষ্ট্র, অর্থনীতি সবই আমাদের পরিচালনা করে, কিন্তু নিজের মনকে পরিচালনা না করতে পারলে সেই পরিচালনার কিছুই স্থায়ী হয় না। তাঁর দেখানো পথ কঠিন, কিন্তু শান্তিময়; নিঃশব্দ, কিন্তু বিপ্লবী। এই কারণেই তাঁকে সময়ের প্রেক্ষিতে একজন নীরব দার্শনিক বিপ্লবীর অভিধায় অভিহিত করা যায়। তিনি কেবল একজন সংগঠক নন, তিনি একটি দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি কেবল একজন বক্তা নন, তিনি একটি অন্তর্জাগরণের সূত্র। তিনি কেবল একজন পথপ্রদর্শক নন, তিনি একটি জীবনবদলের পন্থাও বটে।