বৃহস্পতিবার,

১০ জুলাই ২০২৫

|

আষাঢ় ২৫ ১৪৩২

XFilesBd

ব্রেকিং

২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থ-উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। মোট বাজেট -৭,৯০,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা-৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি -২,২৬,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬%) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা-৫

কেউ বলেছে অর্থসাহায্য লাগবে কেউ করছে বিরোধিতা

ফরিদা পারভীনকে সহযোগিতা চাইতে হবে কেনো?

সুমন বিশ্বাস

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ৮ জুলাই ২০২৫

ফরিদা পারভীনকে সহযোগিতা চাইতে হবে কেনো?

ফরিদা পারভীনকে কেন চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য চাইতে হবে? সরকারের কি চোখ নেই? সম্প্রতি কিছুদিন ধরেই তাঁকে নিয়ে নানান কথা ফেসবুকে লেখালেখি চলছে। কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে ইচ্ছেমতো মন্তব্য জুড়ে দিচ্ছে। ফরিদা পারভিন তো লালন গানের অনন্য সাধিকা। তাঁকে নিয়ে এতো প্রশ্ন কেনো? তাঁর আগে কে আমাদের লালন সাঁইজীর গান এভাবে বিদেশে দেশে প্রচার করেছে? 

বাংলা লোকসংগীতের জগতে ফরিদা পারভিন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি লালন ফকিরের গানের মাধ্যমে বাঙালির হৃদয়ে এক অনন্য আসন গড়ে তুলেছেন। তিনি কেবল একজন কণ্ঠশিল্পী নন, বরং লালন দর্শনের একজন সার্থক বাহক ও ব্যাখ্যাতা। ফরিদা পারভিনের কণ্ঠে লালনগীতি শুধু সংগীতের নয়, এক দর্শনচর্চার, এক আত্মঅন্বেষার মাধ্যম হয়ে ওঠে। তার গায়কিতে যে গাম্ভীর্য, সংযম ও ধ্যানমগ্নতা দেখা যায়, তা এই সময়ের সঙ্গীতজগতের সাধারণ পরিমণ্ডলের তুলনায় একেবারেই ব্যতিক্রম। ফরিদা পারভিনের সংগীত জীবনের শুরু মূলত রাজশাহী বেতারে নজরুলগীতি পরিবেশনার মাধ্যমে। তবে তিনি খুব শিগগিরই গাম্ভীর্যপূর্ণ লোকসংগীত, বিশেষ করে লালনের গান পরিবেশন করার মাধ্যমে স্বতন্ত্র পরিচিতি অর্জন করেন। এই পথচলার পেছনে গুরু হিসেবে তিনি পেয়েছেন শ্রী রামকানাই দাশ ও শেখ লুতফর রহমানের মতো প্রবাদপ্রতিম সংগীতজ্ঞদের, যাঁদের সান্নিধ্যে থেকে ফরিদা পারভিন শিখেছেন শুদ্ধতা, ব্যাখ্যাশীলতা এবং শব্দ ও সুরের নিখুঁত মিলনের কৌশল। এই শিক্ষার প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর প্রতিটি গানে। ফরিদা পারভিনের পরিবেশনায় লালনগীতি হয়ে ওঠে যেন শ্রোতার আত্মার আরাধনার এক মাধ্যম।

লালনগীতিকে তিনি শুধু লোকসংগীত হিসেবে দেখেননি, বরং এর অন্তর্নিহিত দার্শনিক দিকটিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। বিশেষত মানুষের মধ্যে বিভাজনের বিপরীতে লালনের যে “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” ধ্যান—তা ফরিদা পারভিনের কণ্ঠে যেন নতুন ব্যঞ্জনায় ধ্বনিত হয়। তার পরিবেশনায় “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”, “তোমার বান্দা আমি”, কিংবা “মন রে তুমি ভাবনা কেরে”—এই গানগুলো শুধুই সংগীতের রূপ পায় না, বরং এক ধ্যানমগ্ন চিন্তার জগতে শ্রোতাকে নিয়ে যায়। তিনি সংগীত পরিবেশন করেন না, যেন সংগীতের মাধ্যমে মানুষের ভিতরকার মানুষকে জাগিয়ে তোলেন।

ফরিদা পারভিনের গায়কিতে যে বৈশিষ্ট্যগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো শব্দচয়ন, স্বরলিপির যথার্থ অনুসরণ এবং লালনের দর্শনগত ব্যাখ্যার সুক্ষ্মতা। তার কণ্ঠে কোনো অতি নাটকীয়তা নেই, নেই অপ্রয়োজনীয় অলংকার। ফলে তাঁর গানে থাকে এক নির্মেদ গাম্ভীর্য, যা শ্রোতাকে ভাবনায় ডুবিয়ে দেয়। তার গাওয়া লালনের গানগুলোতে শব্দ যেমন উচ্চারিত হয় স্পষ্টভাবে, তেমনি তার ভেতরের তত্ত্বটিও পরিষ্কারভাবে শ্রোতার মনে গেঁথে যায়। এজন্যই তাকে বলা হয় “তত্ত্বগান পরিবেশনের সাধিকা”।

বাংলাদেশের লোকসংগীতের আন্দোলনে ফরিদা পারভিন এক বড় ভূমিকা রেখেছেন। এক সময় যখন আধুনিক গান বা ব্যান্ড মিউজিকের জোয়ারে লোকগান হারিয়ে যেতে বসেছিল, তখন তিনি একা হাতে লালনগীতিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি লালনের দর্শন ও সংগীতকে তুলে ধরেছেন সম্মানের সঙ্গে। ভারতের শান্তিনিকেতন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সসহ নানা দেশে তিনি লালনের গান পরিবেশন করে বাঙালির আধ্যাত্মিক সত্তাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন। তার সংগীতচর্চা প্রমাণ করে, লালনগীতি কোনো গণ্ডিবদ্ধ আঞ্চলিকতা নয়, বরং এক সার্বজনীন মানবতাবাদী দর্শনের ভাষ্য।

ফরিদা পারভিনের এই দীর্ঘ সাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মান তাঁর প্রাপ্তির খাতায় যুক্ত হয়েছে। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া। আজ দেশের যে প্রান্তেই যাওয়া যাক না কেন, ফরিদা পারভিনের কণ্ঠে লালনের গান শোনা মাত্রই শ্রোতা এক অদ্ভুত আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই যে সংগীতের মাধ্যমে দর্শনের উপলব্ধি—তা কোনো কৃত্রিম প্রচারণা নয়, বরং ফরিদা পারভিনের আন্তরিক সাধনারই ফল।

অনেক সময় দেখা যায়, লোকসংগীতশিল্পীরা কেবল ঐতিহ্যগত গান পরিবেশন করে থাকেন। কিন্তু ফরিদা পারভিন ব্যতিক্রম। তিনি লোকসংগীতের ভাষাকে সময়োপযোগী করে তুলেছেন, কিন্তু কখনোই এর শুদ্ধতা বা মূল দর্শনের সঙ্গে আপস করেননি। এই নির্লোভ, নিষ্ঠাবান সাধনার কারণেই তিনি আমাদের কণ্ঠসংগীতের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অর্জন করেছেন। তার সংগীতচর্চা আমাদের শিখিয়ে দেয়—লোকসংগীত কেবল বিনোদনের বিষয় নয়, এটি মানুষের আত্মার শিক্ষা, একটি সমন্বয়বাদী চিন্তার পথ।

ফরিদা পারভিন একদিকে যেমন একজন সুরের সাধিকা, তেমনি অন্যদিকে এক মনীষা, যিনি সঙ্গীতের মাধ্যমে আমাদের আত্মার দরজা খুলে দেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, লালনের গান কেবল গ্রামীণ বাংলার কৃষকের মুখে মুখে উচ্চারিত কোনো সুর নয়—এটি বিশ্বমানবতার এক অবিনশ্বর আহ্বান। তার কণ্ঠে সেই আহ্বান আজো ধ্বনিত হয়, গেয়ে ওঠে—“সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।

যতোদূর জেনেছি, লালনগীতি শিল্পী ফরিদা পারভীনের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়, ডায়ালাইসিস করতে গিয়ে শারীরিক জটিলতা তৈরি হওয়ায় আবারও আইসিইউতে নিতে হয়েছে এই শিল্পীকে। অসুস্থতার খবর জানিয়েছেন তার স্বামী যন্ত্রসংগীত শিল্পী গাজী আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, "ফরিদার তো প্রায়ই ডায়ালাইসিস করতে হয়, এবার পরপর তিনদিন করতে হয়েছে। ডায়ালাইসিস করতে গিয়ে অসুবিধা হয়, তখন তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। নিয়ে তিনবার আইসিউতে ভর্তি করা হল। "একবার কোভিড মহামারীর সময়, ফেব্রুয়ারিতে নিউমোনিয়া হয়েছিল। এবার ডায়ালাইসিস করতে গিয়ে এই সুস্থ হচ্ছে, আবার অসুস্থ হচ্ছে। এইভাবে আর কয়দিন বাঁচবেন তিনি।৭০ বছর বয়সী এই শিল্পী শুধু কিডনি সমস্যা নয়, ডায়াবেটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে। ফরিদা পারভীনের পরিবার চান, বিদেশে এই গুণী শিল্পীর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।

আবদুল হাকিম বলেন, “আমাদের চাওয়া, সন্তানদের চাওয়া, ফরিদা পারভীনকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানো হোক। উনি কি শুধু কারো মা, কারো স্ত্রী? উনি তো জাতীয় সম্পদ। আমরা অর্থ সাহায্য চাই না, চাই তার চিকিৎসাটা যেন ভালো হয়। এজন্য সরকারিভাবে বিদেশে চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হোক।

চলতি বছরের ফব্রুয়ারিতে ১৩ দিন হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন ফরিদা পারভীন। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে।

নজরুলসংগীত দেশাত্মবোধক গান শুরুর পর লালনসংগীত দিয়ে শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি পান ফরিদা পারভীন। সাধক মোকসেদ আলী শাহর কাছে তিনি লালনসংগীতের তালিম নেন। সংগীতাঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে একুশে পদক পান ফরিদা পারভীন। ২০০৮ সালে জাপান সরকারেরফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচারপুরস্কার পান তিনি। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন এই শিল্পী। সেরা প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের গানের যে চর্চা হয়ে এসেছে গেল পাঁচ দশক ধরে, সেটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে প্রায় ১৬ বছর আগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'অচিন পাখি সংগীত একাডেমি' কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা, প্রতিষ্ঠানের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়া, এবং নিজস্ব ভবন না থাকায় প্রতিষ্ঠানটিও টিকে থাকার লড়াইয়ে জর্জরিত।