সোমবার,

০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

|

ভাদ্র ২৩ ১৪৩২

XFilesBd

গেলেন দেখলেন জয় করলেন

চর্যাপদের গান’ নিয়ে ইউরোপের পাঁচ দেশে তানিয়া ও সাইমন

নিজস্ব সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৯:৫৯, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চর্যাপদের গান’ নিয়ে ইউরোপের পাঁচ দেশে তানিয়া ও সাইমন

বাংলাদেশের সাধকশিল্পীদের চর্যাপদ পুনর্জাগরণের অন্যতম শিল্পী, সুরকার, প্রশিক্ষক ও ভাবনগর ফাউন্ডেশনের সদস্য সাধিকা সৃজনী তানিয়া সম্প্রতি ইউরোপের পাঁচটি দেশ- হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, জার্মানি ও ফ্রান্সে ধারাবাহিকভাবে চর্যাপদ পুনর্জাগরণের আসর করেছেন। তিনি মূলত হাঙ্গেরির সিজনি ইস্তেভান ইউনিভার্সিটি অব গ্যিওর (Széchényi István University of Győr), অস্ট্রিয়ার লিনজের রেডিও এফআরও (Radio FRO), জার্মানির উন্নয়নসংস্থা NETZ বাংলাদেশ (NETZ Bangladesh) এবং ফ্রান্সের সাহিত্য-সংস্কৃতির সংগঠন ফ্রান্স কৃর্তি (France Kriti)-র আমন্ত্রণে গত ৪ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ১০টিরও বেশি চর্যাপদ পুনর্জাগরণের আসরে আদিভাষায় রাগাশ্রয়ী সুরে চর্যাপদের বিভিন্ন কবির রচিত চর্যাগান পরিবেশন করেন। 
উল্লেখ্য, তাঁর চর্যাপদ পরিবেশনের আসরের বিভিন্ন পর্বে চর্যাপদ গবেষণার ইতিহাস, চর্যাপদের সাধনার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন প্রাচীন বাংলার চর্যাপদ গবেষক ড. সাইমন জাকারিয়াসহ বিভিন্ন দেশের অধ্যাপক ও গবেষক-পণ্ডিত। সাধিকা সৃজনী তানিয়ার পরিবেশিত চর্যাপদের গান শুধু আসরে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের জন্য উন্মুক্ত ছিল না, তাঁর পরিবেশিত চর্যাপদের গান হাঙ্গেরির একটি টেলিভিশন চ্যানেল (Győrplusz TV) ও অস্ট্রিয়ার লিনজের Radio FRO-তে প্রচারিত হয়েছে।

হাঙ্গেরিতে একাডেমিক আসর ও টেলিভিশনে চর্যাপদ:

হাঙ্গেরির ঐতিহ্যিক শহর গ্যিওরের সিজনি ইস্তেভান ইউনিভার্সিটি অব গ্যিওরে ৫ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্ট ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অধ্যাপক ও গবেষকদের অংশগ্রহণে পঞ্চমবারের মতো ১০দিনব্যাপী “মিডিল বেঙ্গলি রিডিং রিট্রিট-কাম-ওয়ার্কশপ” অনুষ্ঠিত হয়। এবারের মিডিল বেঙ্গলি রিডিং রিট্রিট-কাম-ওয়ার্কশপে ১১টি দেশের ১৬ জন গবেষক, অধ্যাপক, পণ্ডিত যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন- অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইমরে বংঘা ও অধ্যাপক লুভেমির অন্দ্রাস্কা, আমেরিকার ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রেবেকা মানরিং, ফ্রান্সের অধ্যাপক থিবো দুবের, The Oxford Centre for Hindu Studies-এর ফেলো ড.  লুসিয়ান অঙ, ইতালির বংশোদ্ভূত বাংলাদেশের ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টমাস নিউবোল্ড, রাশিয়ার অধ্যাপক মায়া শ্লেখতার, পোল্যান্ডের অধ্যাপক মিহাউ পানাসুক, ভারতের গবেষকদের মধ্যে দি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর গবেষক শ্রুতকীর্তি দত্ত ও আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্বেতা দত্ত এবং বাংলাদেশের অধ্যাপক ও গবেষকদের মধ্যে বাংলা একাডেমির উপপরিচালক ড. সাইমন জাকারিয়া, আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমেদ শামীম, কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর গবেষক তানিশা চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শহিদুল হাসান, প্রভাষক নাজমুল হোসেন এবং বাংলাদেশের ভাবনগর ফাউন্ডেশনের চর্যাপদের গানের পুনর্জাগরণের শিল্পী, সুরকার ও প্রশিক্ষক সাধিকা সৃজনী তানিয়া। 
প্রতিবারের মতো এবারের মিডিল বেঙ্গলি রিডিং রিট্রিটে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন কাব্য, পাঁচালী, গীতিকা প্রভৃতি পাঠ, বিশ্লেষণ, আলোচনা ও অনুবাদ উপস্থাপিত হয়। 
এবারের মিডিল বেঙ্গলি রিডিং রিট্রিট-কাম-ওয়ার্কশপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাঙ্গেরির স্বাগতিক সংস্থা Széchényi István University-র Vice-Rector for International Affairs Dr. Eszter Lukács. Dr. Eszter Lukács ৫ আগস্ট ২০২৫ তারিখ উদ্বোধনী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিষ্ঠানে এমন বৈজ্ঞানিক কর্মসূচি বিশেষ মূল্য বহন করে যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোনো একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের খ্যাতিমান গবেষকরা একত্রিত হন। এই অনুষ্ঠানটি আমাদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ আমরা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমরে বংঘার সহযোগিতায় মধ্যবাংলা কর্মশালা বাস্তবায়ন করতে পারছি। আমরা যেমন নৌকাবাইচে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী, তেমনি বৈজ্ঞানিক সহযোগিতায় আমরা একসূত্রে গাঁথা।”
এরপর সাধিকা সৃজনী তানিয়া নিজের করা সুরে চর্যাপদের কবি বীণাপা রচিত “সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী” শীর্ষক ১৭ সংখ্যক চর্যাগান পরিবেশন করেন। মূলত সাধিকা সৃজনী তানিয়ার পরিবেশিত চর্যাপদের গানের মাধ্যমে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পাঠ উন্মোচন করা হয়। 
এরপর মিডিল বেঙ্গলি রিডিং রিট্রিট-কাম-ওয়ার্কশপের চতুর্থদিন ৮ই আগস্ট ২০২৫ তারিখ গ্যিওরের Czuczor Gergely Benedictine School-এ চর্যাপদের ভাষা বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা উপস্থাপন করেন ফ্রান্সের অধ্যাপক ড. থিবো দুবের। এরপর বিভিন্ন দেশের গবেষক ও অধ্যাপকদের মধ্যে চর্যার একটি পদের বাণীর পাঠ, ব্যাখ্যা ও অনুবাদ উপস্থাপনে নেতৃত্ব দেন সাধিকা ‍সৃজনী তানিয়া। শুধু তাই নয়, তিনি মল্লারী রাগে নিজের করা সুরে একতারা, বায়া ও ঘুঙুর বাদ্য সহযোগে চর্যাপদের কবি ভাদেপা রচিত “এত কাল হাঁউ অচ্ছিলেঁ স্বমোহেঁ” শীর্ষক ৩৫সংখ্যক চর্যাগান পরিবেশন করেন।
মিডিল বেঙ্গলি রিডিং রিট্রিট-কাম-ওয়ার্কশপের অষ্টম দিন ১২ই আগস্ট ২০২৫ তারিখ দুপুর ১২টায়  Czuczor Gergely Benedictine School থেকে হাঙ্গেরির Győrplusz TV  সাধিকা সৃজনী তানিয়ার পরিবেশিত চর্যাপদের কবি কুক্কুরীপা রচিত “দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই” শীর্ষক ২ সংখ্যক চর্যাগান ধারণ করে। সাধিকা সৃজনী তানিয়ার পরিবেশিত চর্যাপদের গানটি টেলিভিশন চ্যানেলটি মিডিল বেঙ্গলি রিডিং রিট্রিট-কাম-ওয়ার্কশপ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে ১৩ই আগস্ট ২০২৫ তারিখ প্রচার করে। Győrplusz TV-এ প্রচারিত গানের লিংক: Híradó 2025.08.13. - YouTube (২০:০০ মিনিটে দেখুন)
একই দিন ১২ই আগস্ট ২০২৫ তারিখ সন্ধ্যা ৭টায়  অনুষ্ঠানটি মিডিল বেঙ্গলি রিডিং রিট্রিট-কাম-ওয়ার্কশপ-এর সমাপনী অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইমরে বংঘা চর্যাপদের কবি কম্বলাম্বরপা রচিত “সোনে ভরিতী করুণা নাবী” শীর্ষক ৮ সংখ্যক চর্যাগানের হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় অনুবাদ উপস্থাপন করেন। পরে সাধিকা সৃজনী তানিয়া নিজের করা সুরে একতারা, বায়া ও ঘুঙুর সহযোগে গানটির সাংগীতিক রূপ পরিবেশন করেন।

অস্ট্রিয়ার দানিয়ুব নদীতীরে চর্যাপদের কাব্যিক সম্মেলন:

অস্ট্রিয়াতে চর্যাপদ পরিবেশনের জন্য ১৫ আগস্ট থেকে ২১ আগস্ট ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত সাধিকা সৃজনী তানিয়া ও ড. সাইমন জাকারিয়া লিনজ (Linz)  শহরে কবি ওয়ালি রে-র বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, অস্ট্রিয়ায় চর্যাপদ গান পরিবেশনের সূচনা করা হয় লিনজ শহর সংলগ্ন Freinberg (Maximilianweg, Sonnenpromenade) পাহাড়ে অবস্থিত একটি বৌদ্ধ স্তুপ অব এনলাইটেনমেন্টের পাদদেশ থেকে। লিনজের শান্ত পাহাড়ের বুকে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ স্তুপের পাদদেশে বসে সাধিকা সৃজনী তানিয়া চর্যাপদের কবি তাড়কপা রচিত "অপনে নাহিঁ মো কাহেরি শঙ্কা" শীর্ষক ৩৭ সংখ্যক চর্যাগান পরিবেশন করেন। আমাদের জানামতে, অস্ট্রিয়ার লিনজে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ স্তুপ প্রাঙ্গণে সাধিকা সৃজনী তানিয়াই প্রথমবারের মতো প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ গান চর্যাপদ পরিবেশন করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। 
অস্ট্রিয়ায় আনুষ্ঠানিক চর্যাপদ পুনর্জাগরণের আসর অনুষ্ঠিত হয় ১৮ই আগস্ট ২০২৫ তারিখ বিকাল ৫টায়। এই দিন অস্ট্রিয়ার লিনজ শহর থেকে সম্প্রচারিত RADIO FRO-তে প্রচারের জন্য দানিয়ুব নদী তীরে “poetologische ortungen+ presents: global revival: a poetic river gathering for peace” শীর্ষক অনুষ্ঠানটি রেকর্ডিং করা হয়। এই অনুষ্ঠানের জন্য Chants mystiques (Charyapada revival & Baul songs) এবং টেক্সট হিসেবে সাধিকা সৃজনী তানিয়ার পরিবেশিত চর্যাপদের গান ও অস্ট্রিয়ান কবি ওয়ালি রে (Wally Re) রচিত কবিতা পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দানিয়ুব নদীর তীরে অষ্ট্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন কবি, চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক-লেখকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি ধারণ করা হয়। এতে বাংলাদেশের আদি বাদ্যযন্ত্র ডমুরু, একতারা, ঘুঙুর ও ডুগির পাশাপাশি দানিয়ুব নদীর ঢেউ ও পাথরের সুর-শব্দ ও উপস্থিত মানুষের হাসি, কণ্ঠস্বর ও “জয় গুরু” সম্বোধন ধারণ করা হয়। RADIO FRO-তে প্রচারের জন্য এই লাইভ রেকর্ডিংয়ে সাধিকা সৃজনী তানিয়া যথাক্রমে চর্যাপদের কবি লুইপা, ভাদেপা, কঙ্কণপা, গুণ্ডরীপা রচিত ১, ৩৫, ৪৪ ও ৪ সংখ্যক চর্যাগানের পাশাপাশি লালন সাঁইয়ের “গুরুর দয়া যারে হয়” ও খোদাবক্স সাঁই রচিত “এসো মা আনন্দময়ী” শীর্ষক গান পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে ভূমিকা বক্তব্য করেন বাংলা একাডেমির উপপরিচালক ড. সাইমন জাকারিয়া। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অস্ট্রিয়ার কবি ওয়ালি রে। এছাড়া, সাধিকা সৃজনী তানিয়ার পরিবেশিত প্রতিটি গানের পর অস্ট্রিয়ার কবি ওয়ালি রে জার্মান ভাষায়  একটি করে নিজের লেখা কবিতা পাঠ করেন। অনুষ্ঠানটি RADIO FRO-তে ২৭শে আগস্ট ২০২৫ তারিখ রাত ১১টায় প্রচারিত হয়েছে। পুরো অনুষ্ঠানের অনলাইন লিংক: https://www.fro.at/global-revival-a-poetic-donau-river-gathering-for-peace/
সাধিকা সৃজনী তানিয়া অস্ট্রিয়ার মাটিতে তৃতীয়বারের মতো চর্যাপদ পরিবেশন করেন ১৯ আগস্ট ২০২৫ তারিখ বিকাল ৪.৩০টায়। এই দিন মূলত অস্ট্রিয়ার RADIO FRO স্টুডিওতে ড. সাইমন জাকারিয়া  ও সাধিকা সৃজনী তানিয়ার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন অস্ট্রিয়ার কবি ওয়ালি রে (Wally Re) এবং অস্ট্রিয়ার রেডিও রেকর্ডিস্ট ও সাংবাদিক Erich Klinger। সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে RADIO FRO-এ সাধিকা সৃজনী তানিয়ার পরিবেশিত “এত কাল হাঁউ অচ্ছিলেঁ স্বমোহেঁ” শীর্ষক ৩৫সংখ্যক চর্যাগান রেকর্ডিং করেন।

চেক রিপাবলিকে চর্যাপদের গান:

প্রাচীন বাংলার চর্যাপদ পুনর্জাগরণ কার্যক্রমকে বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সাধিকা সৃজনী তানিয়া ও সাইমন জাকারিয়া ২১-২৩ আগস্ট ২০২৫ তারিখ চেক রিপাবলিকের প্রাগে ভ্রমণ করেন। সেখানে তাঁরা চেক রিপাবলিকের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গবেষক Jindra Stolcova ও Kristyna Himmer-এর সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এরপর ঘরোয়া পরিবেশে চেক রিপাবলিকের গবেষক Jindra Stolcova ও Kristyna Himmer-কে সাধিকা সৃজনী তানিয়া চর্যাপদের একটি গান পরিবেশন করে শোনান।  

জার্মানিতে চর্যাপদ ও বাউল গান:

চর্যাপদ ও বাউল গান পরিবেশনের জন্য জার্মানি সংস্থা NETZ বাংলাদেশের আমন্ত্রণে সাধিকা সৃজনী তানিয়া ও সাইমন জাকারিয়া ২৩ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত জার্মানির গিসেন ভ্রমণ করেন। সেখানে ২৪ আগস্ট ২০২৫ তারিখ বিকাল ৫টায় “Bengalische Soirée – vom Revival alter buddhistischer Gesänge zu beseelter Volksmusik” শিরোনামে প্রথমবারের মতো চর্যাপদ পুনর্জাগরণের আসর আয়োজন করে NETZ বাংলাদেশ। অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতা করেন Zentrum für interkulturelle Bildung & Begegnung (ZiBB)। অনুষ্ঠানের শুরুতে সূচনা বক্তব্য করেন জার্মান গবেষক ড. ম্যাক্স স্টীলে ও Bernhard Hoeper। 
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে সাধিকা সৃজনী তানিয়া যথাক্রমে চর্যাপদের কবি লুইপা রচিত "কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল" (চর্যাপদ ১), কুক্কুরীপা রচিত "দুলি জুহি পিটা ধরণ ন জাই" (চর্যাপদ ২), কৃষ্ণাচার্যপা রচিত (শাহ আলম দেওয়ানের সুরে সমকালীন বাংলায় সাইমন জাকারিয়ার রূপান্তরিত গীতবাণী) "দৃঢ় করে নাড়ি শক্তি ধ্যানে পেয়ে গেছে", ভাদেপা রচিত “এত কাল হাঁউ অচ্ছিলেঁ স্বমোহেঁ” (চর্যাপদ ৩৫), বীণাপা রচিত “সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী” (চর্যাপদ ১৭) পরিবেশন করেন। এই পর্বে চর্যাপদের গানের পুনর্জাগরণের ইতিহাস ও তত্ত্বগত দিক নিয়ে আলোচনা করেন ড. সাইমন জাকারিয়া। 
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে সাধিকা সৃজনী তানিয়া নিজের ব্যাখ্যাসহ লালন সাঁইয়ের "গুরুর দয়া যারে হয়", "সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন" এবং খোদাবক্স সাঁই রচিত "শুভ সাধুসঙ্গ" ও "এসো মা আনন্দময়ী" গান পরিবেশন করেন। দুটি পর্বেই জার্মান ভাষায় সাইমন জাকারিয়া ও সাধিকা সৃজনী তানিয়ার আলোচনা ও ব্যাখ্যাকে উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের জন্য চারপাশ ভাষায় অনুবাদ করেন ড. ম্যাক্স স্টীলে। অনুষ্ঠানের উপস্থিত ছিলেন জার্মানির বিশিষ্ট গবেষক, লেখক ও সংগীত রসিকদের পাশাপাশি কতিপয় প্রবাসী বাংলাদেশী গবেষক ও শিক্ষক। 
জার্মানিতে চর্যাপদ ও বাউল গান আয়োজনের লিংক: https://bangladesch.org/beitrag/veranstaltungen/gruppen/bengalische-soiree-vom-revival-alter-buddhistischer-gesaenge-zu-beseelter-volksmusik-2958/?fbclid=IwY2xjawMf9bdleHRuA2FlbQIxMQABHrLSnsACN0TB0TBchZNUJhDMseVL_3Ot9K-YUaai2cV9NCwsOsUdV-ZaEJSi_aem_HwltiJ3-t1ENVTYD3SZM0g

ফ্রান্সের মাটিতে শতবর্ষ পরে চর্যাপদের সুরধ্বনি:

সাধিকা সৃজনী তানিয়া ও ড. সাইমন জাকারিয়া ফ্রান্সে চর্যাপদ পুনর্জাগরণের আসরে যোগদানের জন্য ২৫ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত প্যারিস সফর করেন। সেখানে ২৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখ সন্ধ্যা ৭.৩০ থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত Aux Jardins d’Eole, Paris 18ème-এর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে  সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ফ্রান্স কৃতি (France Kriti)-র আয়োজনে "Charyapada Revival: À la découverte de chants mystiques du Bengale" শীর্ষক চর্যাপদ পুনর্জাগরণ আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য করেন গবেষক, অনুবাদক ও ভাষা প্রশিক্ষক জেরেমি কদ্রন। চর্যাপদের গান পরিবেশন করেন বাংলাদেশের চর্যাপদের গানের পুনর্জাগরণের শিল্পী, সুরকার ও প্রশিক্ষক সাধিকা সৃজনী তানিয়া। চর্যাপদের গানের ইতিহাস ও তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন ড. সাইমন জাকারিয়া। ড. সাইমন জাকারিয়া বলেন, চর্যাপদ আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে নেপালের রাজ দরবার গ্রন্থাগারে। নিজের আবিস্কৃত চর্যাপদ প্রথম সংকলন করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে। মজার ব্যাপার হলো, ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এই প্যারিসে এসেছিলেন চর্যাপদ নিয়ে গবেষণা করতে। আজ ঠিক তার ১০০ বছর পরে প্যারিসের মাটিতে চর্যাপদের গানের পুনর্জাগরণের আসর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। যে প্যারিস থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি অর্জন করেছেন, সেই প্যারিসের মাটিতে বাংলাদেশের সাধক শিল্পী সাধিকা সৃজনী তানিয়া চর্যাপদের গান পরিবেশনের মাধ্যমে নতুন আরেকটি ইতিহাস সূচনা করলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশের ভাবসাধক চর্যাপদের গানের সুরকার, শিল্পী ও প্রশিক্ষক সাধিকা সৃজনী তানিয়া বাংলার আদি বাদ্য ডমরু ও শংখ বাজিয়ে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের চর্যাপদের গানের আসরে স্বাগত জানান। গানের আসরের সূচনায় তিনি ড. সাইমন জাকারিয়ার সুরে চর্যাপদের কবি লুইপা রচিত "কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল" শীর্ষক প্রথম পদ পরিবেশন করেন। এরপর তিনি নিজের করা রাগাশ্রয়ী সুরে চর্যাপদের কবি কুক্কুরীপা রচিত "দুলি জুহি পিটা ধরণ ন জাই" (চর্যাপদ ২), বিরূপা রচিত "এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ" (চর্যাপদ ৩), তাড়কপা রচিত "অপনে নাহিঁ মো কাহেরি শঙ্কা" (চর্যাপদ ৩৭), কৃষ্ণবজ্রপা রচিত"তিণি ভুঅণে মই বাহিঅ হেলেঁ" (চর্যাপদ ১৮), বীণাপা রচিত “সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী” (চর্যাপদ ১৭) পরিবেশন করেন।অনুষ্ঠানে সাধিকা সৃজনী তানিয়ার চর্যাপদ পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে বাংলা ভাষায় গানের ব্যাখ্যা ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা উপস্থাপন করেন ড. সাইমন জাকারিয়া। তাঁর আলোচনার ফরাসি অনুবাদ উপস্থাপন করেন জেরেমি কদ্রন। তাদের সমন্বিত পরিবেশনা প্যারিসের সুধীমহলকে বিমোহিত করে।
ফরাসি ও বাংলাদেশী দর্শক-শ্রোতাদের উপস্থিতিতে ভরে উঠেছিলো ‘চর্যাপদ পুনর্জাগরণে’র আসরটি। অনুষ্ঠানে উপস্থিতি ছিলেন বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন এহসানুল হক, ফরাসি অধ্যাপক ড. ফিলিপ বেনুয়া, আলাওল-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. থিবো দুবের, অবারভিলিয়ে শহরের ভাষা ও সভ্যতা বিষয়ক সম্মানিত সভাপতি কার্লোস সমেডো, চিত্রশিল্পী ও লেখক জান্নাতুল নাঈম প্রীতি, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও শিক্ষক হাসনাত জাহান, কবি ও ছড়াকার লোকমান আহমেদ আপন, পুঁথিশিল্পী কাব্য কামরুল, কণ্ঠশিল্পী ইসরাত ফ্লোরা প্রমুখ। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাঙালি এবং ফরাসি দর্শকও এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন।
ফ্রান্স কৃতির পক্ষে জেরেমি কদ্রন, নীনা ক্লাভো, জোয়াসীম জানান, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার উদ্দেশে তাদের এ আয়োজন। তারা বলেন, ‘আমরা চাই বাংলা সাহিত্যের এই প্রাচীন রত্ন শুধু বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে আন্তর্জাতিক পরিসরে ছড়িয়ে দিতে। প্যারিসে শতবর্ষ পর চর্যাপদের প্রতিধ্বনি সেই স্বপ্নেরই প্রতিফলন।’
ফ্রান্সের চর্যাপদ পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানের ভিডিও লিংক দেখুন: https://www.facebook.com/share/v/1Cbhm6hRcm/

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চর্যাপদের পুনর্জাগরণ:
 
এর আগে সাধিকা সৃজনী তানিয়া আমেরিকার দি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর সংগীত বিভাগে চর্যাপদের গানের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। এছাড়া, শিকাগোর সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউটসহ জাপান, নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে চর্যাপদের গান পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি সমূহ সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। এবারে ইউরোপ সফরে তাঁর চর্যাপদ পরিবেশন শুধু কোনো সংগীতের আসর ছিল না, বরং এটি ছিল চর্যাপদ পুনর্জাগরণের আন্তর্জাতিক অভিযাত্রার পূর্ণাঙ্গতা বিধানের পথে দীপ্ত পদক্ষেপ।
সাধিকা সৃজনী তানিয়ার ইউরোপ সফর প্রমাণ করল—বাংলার আদি বৌদ্ধ গান চর্যাপদ আজও বিশ্বমঞ্চে সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর কণ্ঠে প্রাচীন সাধনার এই গীতধ্বনি ইউরোপের দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে, আর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দিয়েছে এক নতুন জাগরণ।