সোমবার,

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

|

ভাদ্র ৩১ ১৪৩২

XFilesBd

লালন সাঁইয়ের গানের ধ্রুবতারা ফরিদা পারভীন

নিজস্ব সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ১৯:৫৯, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

লালন সাঁইয়ের গানের ধ্রুবতারা ফরিদা পারভীন

বাংলার লোকসংগীত ও লালনগীতির উজ্জ্বল নাম ফরিদা পারভীন আর নেই। বাংলার আকাশে দ্রুবতারা হয়ে গেলেন লোকসংগীতের এই বিশিষ্ট গবেষক। ফরিদা পারভীনের মৃত্যু সম্পর্কে গণমাধ্যমকে তথ্য দিয়েছেন তার মেয়ে জিহান ফারিহা। ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানের জন্য খ্যাত ফরিদা পারভীনের মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। 

কিডনি ও ফুসফুসের জটিলতায় দীর্ঘদিন ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। নিয়মিত ডায়ালাইসিসের অংশ হিসেবে গত ২ সেপ্টেম্বর তাকে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডায়ালাইসিসের পর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। এরপর তিনি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত বুধবার অবস্থার অবনতি হলে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হয় তাকে। শনিবার রাতে সেখানেই থেমে যায় তার প্রাণস্পন্দন। ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীনের সংগীতজীবন শুরু হয় মাত্র ১৪ বছর বয়সে, ১৯৬৮ সালে। শুরুতে নজরুলসংগীত ও আধুনিক গান গেয়েছেন তিনি। তবে জীবনের মূল পরিচয় হয়ে ওঠে লালনসংগীত। কুষ্টিয়া শহরে দীর্ঘদিন লালনের গান চর্চা করেছেন এই শিল্পী।

শুরুতে নজরুলসংগীত, পরে আধুনিক গান দিয়ে ফরিদা পারভীনের যাত্রা শুরু হলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে। 

ফরিদা পারভীনের গানের হাতেখড়ি মাগুরা জেলায়। সেটা ১৯৫৭-৫৮ সালের কথা, তখন তিনি মাত্র চার-পাঁচ বছরের মেয়ে। সে সময় মাগুরায় তাকে গানে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। এরপর যেখানেই তিনি থেকেছেন, সেখানেই বিভিন্নজনের কাছে গানের তালিম নিয়েছেন। স্বরলিপি দিয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কণ্ঠে তোলার কাজটি তিনি ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলীর কাছেই প্রথম শেখেন। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীতশিল্পী নির্বাচিত হন। 

ফরিদার পারভীনের লালন সংগীতের সঙ্গে যোগাযোগ হয় মূলত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। তখন তিনি কুষ্টিয়াতে ছিলেন। সেখানে তাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন মোকছেদ আলী সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা পারভীন তার কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শেখার মাধ্যমে লালনের গানের তালিম নেন। মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালনসংগীত শেখেন তিনি। তখন থেকে তার কণ্ঠে লালন সংগীতের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

ফরিদা পারভীন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় চলে আসেন। তার গাওয়া গান দিয়ে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস শুরু হয়; বাজানো হয় বাংলাদেশ বেতারে। 

সারা দুনিয়ায় লালন সংগীতকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের অবদান সবার জানান। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বদরবারেও তিনি লালনেনর গানের বাণী ও সুরকে প্রচার করে গেছেন। জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশে লালনসংগীত পরিবেশন করেছেন ফরিদা পারভীন। সেসব দেশ থেকে পেয়েছেন সম্মান ও স্বীকৃতি। লালনসংগীতের ওপর তার গবেষণা রয়েছে, যা সাঁইজিকে বিশ্বদরবারে দিয়েছে আরো উঁচু স্থান। 

বাংলা সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৮৭ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে চলচ্চিত্র ‘অন্ধ প্রেম’-এর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সেরা নারী কণ্ঠশিল্পী) এবং ২০০৮ সালে জাপানের ফুকুওয়াকা পুরস্কার অর্জন করেন। ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে অমর হয়ে আছে বহু গান, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘নিন্দার কাঁটা’, ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম’, 'এই পদ্মা এই মেঘনা’। গান গেয়ে কাটানো ৫৫ বছরের দীর্ঘ পথচলা আজ হলো, তবে ফরিদা পারভীন ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলবেন বাংলা গানের অসীম আকাশে।

প্রধান উপদেষ্টার শোক
ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। 

শনিবার (১২ সেপ্টেম্বর) এক শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নজরুলগীতি, দেশাত্মবোধক নানা ধরনের গান করলেও শ্রোতাদের কাছে ফরিদা পারভীনের পরিচিতি ‘লালনকন্যা’ হিসেবে। পাঁচ দশক ধরে তার কণ্ঠে লালন সাঁইয়ের গান মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। তার গান আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্লীন দর্শন ও জীবনবোধকেও নতুন মাত্রায় তুলে ধরেছিল।

“নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও গান থেকে দূরে থাকেননি ফরিদা পারভীন; সংগীতের প্রতি তার এই অনুরাগ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে,” বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। 

একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গুণী শিল্পী বাংলাদেশের সংগীত জগতে যে অবদান রেখেছেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে  মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তার অবদান বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিত্যনতুন চিন্তা ও সৃষ্টির খোরাক জোগাবে।

প্রধান উপদেষ্টা লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীনের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুলের শোক
ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

শোক বার্তায় তারেক রহমান বলেন, ফরিদা পারভীন ছিলেন লালন সংগীতের জীবন্ত কণ্ঠ। তার অসাধারণ কণ্ঠে লালনগীতি শুধু সংগীতের মাধুর্য নয়, বরং মানবতা-সাম্য-ভালোবাসা ও সত্যের বাণী হয়ে মানুষের অন্তরে গভীরভাবে অনুরণিত হবে।

ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে জাতি যে মহান গুণী শিল্পীকে হারাল, বাংলা সংগীতে তা আর পূর্ণ হবার নয়, বলা হয় শোক বার্তায়।

শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদেরসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভক্ত-শ্রোতাদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন তারেক রহমান।