
কর্পোরেট দুনিয়ায় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিলুপ্তির সম্ভাবনা: প্রযুক্তির ঝড়, না কি মানবিক পুনর্জাগরণ?
এম. ইমরান
প্রযুক্তি আজ কর্পোরেট বিশ্বের প্রতিটি স্তরে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে। অফিসের ফাইল, উৎপাদন ব্যবস্থা, বিপণন কিংবা প্রশাসনিক কাজ, সবখানেই এখন স্বয়ংক্রিয়তার ছোঁয়া। কিন্তু সবচেয়ে আলোচিত রূপান্তর ঘটছে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায়। একসময় যাকে বলা হতো প্রতিষ্ঠানের হৃদয়, সেই মানবসম্পদ বিভাগ এখন প্রযুক্তির আগমনে নতুন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। কেউ বলছেন, যন্ত্রনির্ভর যুগে এই বিভাগ একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন, প্রযুক্তিই এই বিভাগকে দেবে নতুন জীবন এবং আরও মানবিক এক রূপ। দেশের বড় বড় ব্যাংক, টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান কিংবা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, বেতন, উপস্থিতি, ছুটি, কর্মী তালিকা, সবকিছুই এখন সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। জীবনবৃত্তান্ত যাচাই করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কর্মীদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে যান্ত্রিক বার্তাবাহক। ফলে আগের মতো কাগজপত্র ঘেঁটে ফাইল সাজানো বা হিসাব কষে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন পড়ছে না। কাজের গতি বেড়েছে, ভুল কমেছে। কিন্তু এই সুবিধার আড়ালে এক প্রশ্ন জেগেছে, মানবিক সংযোগ কি ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে? বিশ্বজুড়ে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নামী দামী প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে তাদের মানবসম্পদ কর্মীদের সংখ্যা কমিয়ে যন্ত্রনির্ভর ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করছে। খরচ কমছে, কার্যকারিতা বাড়ছে কিন্তু মানুষকেন্দ্রিক দিকটা হারিয়ে যাচ্ছে। এই ঢেউ বাংলাদেশের কর্পোরেট পরিবেশেও পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে ব্যাংক, তথ্যপ্রযুক্তি ও আর্থিক খাতে মানবসম্পদ কার্যক্রম দ্রুত ডিজিটাল রূপ নিচ্ছে। অনেক কোম্পানি এখন বাইরের সংস্থার মাধ্যমে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ করাচ্ছে। এতে খরচ বাঁচছে বটে, কিন্তু কর্মীদের প্রতি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা কিছুটা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। তবুও প্রশ্ন থাকে: মানবসম্পদ বিভাগ কি সত্যিই হারিয়ে যাবে? উত্তর হলো না। কারণ মানুষকে বোঝার কাজ এখনো মানুষই সবচেয়ে ভালো পারে। বাংলাদেশের কর্মসংস্কৃতি এখনো সম্পর্কনির্ভর। কর্মীদের মনোবল, উদ্বেগ, হতাশা বা অনুপ্রেরণার মতো সূক্ষ্ম বিষয় বুঝতে হলে দরকার মানবিক সংবেদনশীলতা। কোনো যন্ত্র তা পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারে না। তারপরও রয়েছে আইনগত বাস্তবতা। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী, নিয়োগ, বরখাস্ত, নারী কর্মীদের সুরক্ষা, বৈষম্য বা হয়রানির অভিযোগ নিষ্পত্তি এসব ক্ষেত্রে মানবসম্পদ বিভাগ অপরিহার্য। এছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ গঠনের দায়িত্বও এই বিভাগের ওপরই থাকে। প্রযুক্তি হয়তো প্রক্রিয়াকে দ্রুত করতে পারে, কিন্তু মানুষ তৈরি করতে পারে না। বাংলাদেশের কর্পোরেট পরিবেশে এখনো মানবিক বিবেচনা বড় ভূমিকা রাখে। সিদ্ধান্ত, নিয়োগ, পদোন্নতি, সবকিছুতেই মানুষের বিচারই মুখ্য। তবে পরিবর্তনের ছোঁয়া স্পষ্ট। ব্যাংক খাতে ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক বা ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার ব্যবহার শুরু করেছে।
পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের উপস্থিতি, বেতন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটেছে। কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান এমনও পথ নিয়েছে যেখানে আলাদা মানবসম্পদ বিভাগ নেই, দল নিজেরাই সদস্য নির্বাচন ও মূল্যায়ন করে। তবুও অধিকাংশ কোম্পানিতেই মানবসম্পদ বিভাগই এখনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিভাগ কীভাবে বদলে যাচ্ছে। আগের মতো শুধু প্রশাসনিক দায়িত্বে সীমাবদ্ধ না থেকে এটি ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠছে। এখন মানবসম্পদ বিভাগের কাজ শুধু নিয়োগ বা ছুটি অনুমোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা এখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোথায় বিনিয়োগ হবে, কোন দক্ষতাকে আরও উন্নত করা দরকার, কিংবা নেতৃত্ব বিকাশে কোন পথ নেওয়া হবে। প্রযুক্তির সহায়তায় এই বিভাগ এখন তথ্য বিশ্লেষণ করছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে প্রমাণের ভিত্তিতে, অনুমানের ওপর নয়। এর পাশাপাশি এক নতুন ভূমিকা দেখা যাচ্ছে আর তা হলো- কর্মী অভিজ্ঞতা ব্যবস্থাপনা। এখন মানবসম্পদ বিভাগের কাজের বড় অংশ হচ্ছে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ, কাজের পরিবেশ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। অর্থাৎ, কর্মীদের শুধু কর্মী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে দেখা, এটাই এখন এই বিভাগের মূল দায়িত্ব। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও একই ধারা লক্ষ্য করা যায়। ভারতে টাটা কনসালটেন্সি, ইনফোসিস ও উইপ্রোর মতো প্রতিষ্ঠান তাদের মানবসম্পদ কাজের বড় অংশ স্বয়ংক্রিয় করেছে। কিন্তু তারা নতুন করে “মানুষ ও সংস্কৃতি বিভাগ” গঠন করেছে, যেখানে প্রযুক্তি ও মানবিক মূল্যবোধের মেলবন্ধন ঘটছে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানেও বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরণের মিশ্র পদ্ধতি গ্রহণ করেছে যেখানে এক অংশ প্রযুক্তিনির্ভর, অন্য অংশ মানবিক সিদ্ধান্তনির্ভর। বাংলাদেশেও সেই পথেই ধীরে ধীরে এগোচ্ছে রূপান্তর। ভবিষ্যতের মানবসম্পদ বিভাগ হবে ছোট কিন্তু দক্ষ, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এবং কৌশলনির্ভর। প্রযুক্তি আসলে শত্রু নয়, বরং সহযোগী। কর্পোরেট দুনিয়ার সাধারণ ও পুনরাবৃত্ত কাজগুলো প্রযুক্তি করে দেবে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে, আর মানুষ মনোযোগ দেবে কৌশল, সৃজনশীলতা ও সহানুভূতির জায়গায়। তাই প্রশ্নটা এখন আর “মানবসম্পদ বিভাগ থাকবে কি না” সেটা মুখ্য নয়; বরং “কীভাবে থাকবে” সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতের মানবসম্পদ কর্মকর্তাদেরও নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে নতুনভাবে। তথ্য বিশ্লেষণের দক্ষতা, ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহারের পারদর্শিতা এবং কর্মী অভিজ্ঞতা উন্নয়নের কৌশল জানতে হবে। যাদের এই পরিবর্তনের মানসিকতা থাকবে না, তারা হয়তো পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু যারা প্রযুক্তিকে সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করবে, নিজেকে আপডেট করতে পারবে সময়ে সাথে সাথে, রাই টিকে থাকবে আগামী দিনের প্রতিযোগিতায়। সত্যিটা হলো, মানবসম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত হচ্ছে না- বরং পুনর্জন্ম নিচ্ছে। এটি এখন কম প্রশাসনিক, বেশি মানবিক; কম প্রথাগত, বেশি কৌশলনির্ভর। প্রযুক্তি মানুষকে প্রতিস্থাপন করবে না, বরং তাকে আরও সক্ষম করে তুলবে। ভবিষ্যতের কর্পোরেট দুনিয়ায় যারা প্রযুক্তির সঙ্গে মানবিকতা, তথ্যের সঙ্গে অনুভূতিকে একসাথে ধরে রাখতে পারবে, তারাই হবে প্রকৃত মানব স্থপতি, যারা গড়ে তুলবে আগামী দিনের কর্মসংস্কৃতি, যেখানে মানুষ ও মেশিন একসাথে এগিয়ে যাবে উন্নতির পথে।
[ লেখক: এম. ইমরান, করপোরেট রূপান্তর ও কর্মসংস্কৃতি বিষয়ক মানবসম্পদ বিশ্লেষক এবং গবেষক ]