
অখিল পোদ্দারের দুটি শারদ গল্প
বাইচের নৌকো
এবারও বাইচ খেলা হবে। বেলাগাছির পদ্মা থেকে নৌকো আসবে আমলাবাড়ির গাঙে। নাজিরগঞ্জের সত্য সাহা খেলবে কালাম মেম্বারের সাথে। সোয়া একশ হাত। তো একশ হাত ঠিক আছে তো সোয়া লাগে কেনো? ঐটুকুতে আসন করে সত্য সাহার গোঁসাই ছবেদ ঘোষ। মিষ্টি দোকানের ময়রা। ঘোষের কারখানায় ছানা কাটতো। ছবেদের নামের শেষে তাই যুক্ত ঘোষ। পাবনা বেড়ার মহেন সাঁইয়ের ঝোলা টেনে ছবেদ আলী গোঁসাই বনে গেছে। ভক্তও বেশ। মোকামদরদী ছবেদ আলী তাই পুরোণো নামে নেই। মুখে মুখে কবেই নামের উত্তোরণ। প্রবহমান নদী যেমন। অন্য স্রোতে মিললেই ভিন্ন নামে ডাকা। পেশাজীবীর প্রমোশন আছে, সাধুকূলে নয় কেনো?
চুলে জটা, দাড়ি মোচে ভরপুর ছবেদ গোঁসাই। দেহের কোথাও ময়লা নেই। পাতলা একহারা। বকফুল গাছের মতো। মন ফর্সা। অন্য বৃদ্ধরা যেমন সুন্দর- তেমনি।
ছবেদ ঘোষ নৌকোয় বসলে বাইচে জিতে। ঐ যে সোয়া হাত কাঠামো! ওখানে আসন করেন। সেটুকু নিম কাঠ দিয়ে বাঁধানো। ভেতরে কুফরি কালাম নেই। বিশ্বাসও করেন না। ঐ একজনেরই নেহার করেন। যিনি তাঁকে দিয়েছেন ভরপুর। তাঁর নামে মাল্লাদের শক্তি যোগান। স্বরূপে নজরবন্দি হয় পাড়ের মানুষ। মন তার একজনকেই চেনে-মহেন সাঁই। যমুনার ভাঙন তখন বেড়ার অদূরে। চৌহালি থানা সর্বস্বান্ত। কই যাবা? তামাই বেলকুচি নাকি এনায়েতপুর! পরে নাজিরগঞ্জে থিতু। অন্ধ রাতে সাধুসঙ্গের দোলায় ছবেদকে খুঁজে পান মহেন গোঁসাই। সেই থেকে প্রেম। ইন্দ্রবারি অনুরাগে আচ্ছন্ন। দেহ রাখার আগ অব্দি সবকিছুতে ঐ ছবেদই। লোকে বলে, মহেন গোঁসাই ছেলে মেয়ে বুঝলো না, আত্মীয় জানলো না- চিনলো শুধু ছবেদকে।
সত্য সাহা নাজিরগঞ্জের ধনী ব্যবসায়ী। ব্যাপারিও বটে। চল্লিশের পর চিন্তায় ভর ছবেদ আলী। মনকুঠুরিতে নিত্য শুধু ছবেদ বাজে। লোকসান হাতরে ব্যবসা ক্রমশ দরিদ্র হয়। তবু সত্যর দাপট কমে না। যেমন ম্লান হয়নি বৈঠার হাত। সুতরাং খেলা হবে জীবনের ;
বাসন্তীর মা
বাংলাবান্ধার সীমায় দাঁড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেলে। মহালয়া তখনও দূর অস্ত। শীত ক্রমশ নিঝুম হতে চায় উত্তরের শেষ রেখায়। শিউলী ফুটেছে। কুয়াশা জমাটবদ্ধ হয়নি এত্তো ভোরে। রাতের শিশির টুপটাপ। ফুল বেয়ে পড়ে তুলসিতলে। শাদা শাদা ঘ্রাণে মৌমাটি ভরপুর।
রাত গড়ালে নিশি আসে। তুলশির আসনে গড়াগড়ি যায় বাসন্তীর মা। ওবাড়ি এবাড়ি শুধু জাগে। বাস্কেটে জমাটবদ্ধ ব্লাউজ পেটিকোট। একফাঁকে লক্ষীর আসন। বাচ্চাদের পোশাকে জড়ানো সে পট। অন্তর্ঘাত যেনো সইতে পারে পেইন্টিং। বেশ আদরে ভাঁজ করা দূর্গার ছবি। আদ্যাশক্তি কূলকুণ্ডলিনী মহাশক্তি মহামায়া। তবু জিহ্বা জড়িয়ে যায়, মাথা ধরে আসে। অন্য রাতের চেয়ে ভোর আজ তাড়াতাড়ি হতে পারে। পুরুষকণ্ঠ তাই তো বললে। মেয়েরা মায়েরা ফুসুরফাস কী যেনো বলাবলি করে। প্রতিবেশিদের মুখে রুমাল নেই। তবু তারা কথা বলছে চোরালাইটের মতো-নিস্প্রভ। শব্দ যেনো ধ্বনি রূপে দূর না পেড়োয়।
পাছবাড়ির আদাড়ে একটা পাখি জানান দিলো। অল্পদূরে গাবগাছ। মগডাল হতে পাখা ঝাপটালো কে যেনো। রাত নিঝুম। যেতে হবে দূরে। গন্তব্যহীন। নাম শুনেছে রানাঘাট। পৃথিবীর শেষ বোধহয় সে স্থান।
তুলশি বেদিতে মাথা নোয়ান বাসন্তীর মা। বেশ সন্তর্পণে। বাড়ির কর্তা খিড়কি বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে। ছেলেমেয়েদের চোখে হাপিত্যেশ। আমরা কৈ যাচ্ছি রে দিদি। মা জানে। কেনো, তুই জানিস নে!
চোখে জল। বাসন্তীর মা কাঁদছেন। তুলশি বেদিতে ফোটায় ফোটায় শিশির। টুপটাপ এক দুইটা শিউলীতে শাদা। হঠাৎ হাউমাউ। প্রতিদিন একটি গাছকে ঘিরে শুরু দিনের সূচনা। নিকানো গোছানো শ্রদ্ধা সনির্বন্ধ-সব। সব ফেলে শব যাচ্ছে নিরুদ্দেশ। বাসন্তীর মা পারলেন না। রাতের নিরবতা উতরে দিলেন। পাখা ঝাপটালো চড়ুই শালিক। গোরু ডেকে উঠলো আঁ-মাঁ রবে। খ্যাদন কুকুরের দল ডাকলে না। লেজ নাড়ছে এ কোনা সে প্রান্তে। নসিমন ভ্যান এসেছে। দুজন যাবে দুদিকের রাস্তায়। অতপর দেখা হবে বড় রাস্তায় গনি মেকারের দোকানের সামনে। পাড়াটুকুতে যতো সমস্যা।
পুজো আসছে। কতো যে কাজ বাকি। এমন দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘা ফেলে দেশান্তরি হয়েছিলেন বাসন্তীর মা। সব মনে আছে। সে রাতের কথা, পাড়াতো মানুষ, সবার চেহারা। এমন আর কাউকে পেলেন না। প্রতিবেশী ছাড়া কে আর ব্যথা বোঝে? নুন তেল শুকনো মরিচ ধার। এই ঝগড়া তো পরদিন মিল। দলবেঁধে চৈতালি ওড়ানো। হর-পার্বতীর শ্লোক শোনা। বেহুলার ভাসানে নুজাই শেখের কালীর সাজন। গ্রামভর বিশুদ্ধ মানুষ। সবাই সবার কল্যাণপ্রার্থী।
বাসন্তীর মা আয়ুষ্কাল কাটান। বারান্দার মরা চৌকিতে রাত দিন এপাশ ওপাশ। মাঝেসাঝে ওষুধ খান। অনিয়মিত খেতেই ভালো লাগে। সংসার স্বচ্ছল। স্বস্তি শান্তি কোনোটাই নেই। এতো এতো সময় পেরুলো। শুধু দাসেরকান্দির মতো গ্রাম পেলেন না আর। মায়া ছিল ওখানেই। তুলশিতলায় ভক্তিতে। ও গ্রামের গোরু বাছুর পোকপাখালি ছাগল ভেড়া সাপ বাদুড় সবাই মানুষের কথা বুঝতো। তাহলে পর্বতটাও দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই! নাকি ক্ষয়ে ক্ষয়ে বুড়ো বাড়ন্ত আমার মতো!