সোমবার,

১৩ অক্টোবর ২০২৫

|

আশ্বিন ২৮ ১৪৩২

XFilesBd

রবীন্দ্রনাথ ও অ্যাই গরু সরে যা মার্কা সমাজ

এ বি এম সিরাজুল হোসেন

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ৬ অক্টোবর ২০২৫

রবীন্দ্রনাথ ও অ্যাই গরু সরে যা মার্কা সমাজ

সরু রাস্তায় কোন গরু দাঁড়িয়ে রাস্তা আটকে রাখলে আমরা গলা উচ্চ স্বরে উঠিয়ে রুক্ষ করে বলি “হায়…. হাট.. হাট..”। গভীর রবীন্দ্রপ্রেমীরা বা শান্তিনিকেতনে পড়ে এসেছে যারা তারা নকি তেমন পরিস্থিতিতে গলা মিষ্টি করে বলে "অ্যাই গরু, সরে যা..."। গরুর সাথে ভাব বিনিময়ের সময় গরুর খুরে না ঢুকে, গরুর ভাষায় কথা না বলে ভদ্র মানুষের ভাষায় কথা বলাটা এমপ্যাথির চুড়ান্ত অভাব বলে আমার মনে হয়।
 
"অ্যাই গরু, সরে যা..." শুনে গরু যে সরে যাবে না এটা একেবারে নিশ্চিত। তবে গরুর প্রতি এত মিষ্টি ভাষার অভিবাদন শুনে কোন দয়ালু পথাচারী বা রাখাল বালক ছুটে আসবে সেই ভদ্র ও মিষ্ট কোমল ভাষার ব্যক্তিটিকে সহায়তা করতে। তারপর গাছের ডাল ভেঙে বা হাতের পাচন (গরু মারা লাঠি) দিয়ে বেয়াদব গরুটাকে পিটিয়ে রাস্তাছাড়া কেন, সেই এলাকা ছাড়া করে দেবে। 

গভীর রবীন্দ্রপ্রেমীরা বা শান্তিনিকেতনে যারা পড়ে এসেছে যারা তারা তখন উক্ত সাহায্যকারীকে মধুর ভাষায় অসংখ্য ধন্যবাদ দেবে গরুটিকে সরিয়ে দেবার জন্য। মনে মনে তখন তারা এই আত্মপ্রসাদও লাভ করবে যে সে গরুর সাথেও তারা যে মিষ্ট ভাষা ছাড়া আচরণ করে না।

যারা “হায়…. হাট.. হাট..” বলে গরু না তাড়িয়ে "অ্যাই গরু, সরে যা..." বলে গরু তাড়ায় তারা ঘনিষ্ট নারী পুরুষের সম্পর্ক অর্থাৎ গভীর প্রণয় আবেগ কিভাবে প্রকাশ করে সেটা কৌতুহলের দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথের সময় প্রায় সারা দুনিয়ার শিক্ষিত ভদ্র সমাজে গভীর আবেগকে আবেগের মাধ্যমে প্রকাশ করা ছোটলোকি ব্যাপার স্যাপার ছিল। মনে তৈরী হওয়া গভীর আবগকে ভদ্র মিষ্ট ভাষায় প্রকাশই তখন ভদ্রতা ছিল। 

রবীন্দ্রনাথ তার গানে, কবিতায়, গদ্যে তাই করেছেন। তার মনে তৈরী হওয়া আবেগকে আবেগগত চিন্তায় (ইমোশোনাল কগনিশনে) পরিণত করেছেন। তাঁর চরিত্রদের আবেগে পাগল হবার বিবরণ তিনি মূলতঃ দেন নাই, তিনি তার চরিত্রদের আবেগকে চিন্তায় পরিণত করে সেই চিন্তাটা পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন।

এর ফলে যে সমস্যাটা হয়েছে যে তার গান, সাহিত্য, চরিত্র আবেগগতভাবে সুস্থ বা আবেগগতভাবে অনুভূতিপ্রবণ যারা বা আবেগগত এমপ্যাথি যাদের আছে (অ্যাফেকটিভ এমপ্যাথি) তাদের মনে আবেগ জাগায় না। “হায়…. হাট.. হাট..” মনে যে আলোড়ন তৈরী করবে "অ্যাই গরু, সরে যা..." নিশ্চই সেটা করবে না। 

সম্প্রতি ফ্রন্টিয়ার্স ইন হিউম্যান নিউরোসায়েন্স জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে “অ্যাফেকটিভ এন্ড কগনিটিভ এমপ্যাথি ইন অ্যাডেলেসেন্টস উইথ অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার” নামে। এই গবেষণায় যেটা পাওয়া গেছে সেটা হল যে সকল শিশু কিশোরদের অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে তারা কগনিটিভ এমপ্যাথিতে অক্ষম। 

এর মানে কোন পরিস্থিতিতে কেউ যদি আনন্দিত হয় বা দুঃখ পায় কিন্তু সেটা সে দেহগতভাবে বা আবেগগতভাবে প্রকাশ না করে, তাহলে তারা সেটা বুঝতে অক্ষম। অপরদিকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার সংক্রান্ত সমস্যা যাদের রয়েছে তারা অ্যাফেকটিভ এমপ্যাথি বা আবেগগত ভাব প্রকাশের শুধুমাত্র ইতিবাচক অংশ (আনন্দ - উল্লাস) বুঝতে পারে, নেতিবাচক অংশ (দুঃখ - বেদনা) বুঝতে পারে না। 

আমাদের সমাজে শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত শ্রেণীর একটি বিশাল অংশ রয়েছে যারা যুক্তি, বিজ্ঞান, সাহিত্য এমন নানা ক্ষেত্রে প্রতিযোগীতায় খুব ভাল করেন। তাদের অনেকেই আবেগগত ভাব বুঝতে ও প্রকাশে দুর্বল। রবীন্দ্রনাথ তাদের জন্য একটি আবেগগত অনুকরণের গুগল ট্র্যানস্লেটর যেন। কোন পরিস্থিতিতে আবেগগতভাবে কি ভাবা বা করা উচিত তারা সেটা রবীন্দ্রনাথ থেকে ধার করে প্রয়োগের চেষ্টা করেন।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ট্যাকটিক্যাল বা স্ট্র্যাটেজিক এমপ্যাথি। এর অর্থ নিজে আবেগগতভাবে অক্ষম হওয়াতে অন্যের থেকে ধার করে ভাব ধরা, যে কোন আবেগগত পরিবেশে কোন রূপ ধারণ করতে হবে। যেটা একটা ব্লাফ যেটা এইসব রাবিন্দ্রীকদের সাথে যারা আবেগগত সম্পর্কে গেছেন তাদের বোঝার কথা যদি না তিনিও তেমন হন।