রোববার,

০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

|

ভাদ্র ২২ ১৪৩২

XFilesBd

সাংবাদিক অখিল পোদ্দারের এক গুচ্ছ কবিতা

ড. অখিল পোদ্দার (Dr. Akhil Podder)

প্রকাশিত: ০৪:১১, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সাংবাদিক অখিল পোদ্দারের এক গুচ্ছ কবিতা

মানুষ দাঁড়িয়ে রয় ছায়াতে পার হয় নদী

 

জাহাজটা থেমে ছিল ঢেউয়ের ওপর

অথচ আমরাই হেঁটে হেঁটে পার হয়ে গেলাম

দিগন্তবেড়া নদী

ওপরে-

নিস্তরঙ্গ মেঘের আবছায়া ;

 

ডেকের ওপর রেলিং ধরে দাঁডিয়ে ছিলেন

যিনি-

তিনি বুঝলেনই না

জলযান থেমে থাকলেও

যাত্রীরা পৌঁছে যায় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে?

 

জাহাজটা ঠিকই থেমে ছিল

মলিন স্রোতের ওপর

নোঙর হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু আমরাই

সাঁতার না জানা মানুষ নৌকাবিলাসে

সাঁতরে পার হয় পারমাণবিক মন

দিগন্তজোড়া নদী আজও দাঁড়িয়ে আছে

রসবতী মেঘ মাথায় করে ক্ষণে বহুক্ষণ ।

 

(১২ মে ২০২৪, শীতলক্ষা, নারায়ণগঞ্জ)

 

একই জঙ্গলজীবন

 

এসো তবে-

সময় হলে, আমার তাড়া নেই

গোধুলিফেরত গরুর দড়ির মতো অলস

কী দ্যাখো মানুষ, মেঘ না-কি বসতবাড়ি ?

একই।

অসহায় কালো নীল কিংবা ফেকশি কমলা

যে দেশেই উড়ুক না কেনো

আকাশই তো, একটাই গড়ন

উড়বে ফিরবে

অতপর ঝরাবে চোখের জল

একই -

সে জলেও আছে নুনের ছিটে

আটলান্টিক পাড়ি দেয়া অথৈ সমুদ্দর

ওপর দিয়ে চলে বলে

যায় না দেখা ঢেউয়ের ক্লান্তি

একই

মাতাল মানুষ যেমন আশায় থেকে

কাটিয়ে দেয় আস্ত এক জীবন

এসো কিন্তু -

সময় হলে,

যেদিন তোমাদের দেশে সুখ আসবে, ধন্বন্তরি স্বস্তি

নাকি, সেদিনও বলবে

একই -

জীবন মস্তিষ্কের চেয়ে অবাধ্য হতে শেখেনি

ফেকশি রং, বৃষ্টির মিহিন ঝরে পড়া

তৃষ্ণার্ত মেঘ যেভাবে -

দুর্বার অশান্তি নিয়ে আসে ঘনদলে

আচ্ছা মানুষ

আপনারা কী আজও দেখেননি

দোকতা পাতার কষ খাওয়া পুষ্পরাজ

কিভাবে শ্যুট টাই পরে অভিনব হয়

একই সমান্তরালে চলবে পৃথিবী

তাই

কাজ কমিয়ে দিয়ে বলতে শিখেছি

আমার তাড়া নেই

সময় হলে ফিরে আসতে পারো

এবং

আপনারাও

 

(২৬ আগস্ট ২০২৫, বরইচারা, খোকসা, কুষ্টিয়া)

 

 যেতে আসতে কাটে করাতে

 

রাস্তা শেষ

গলির মাথায় আর কিছু নেই

পৃথিবীর শেষ এখানেই !!

তবু

দাঁড়িয়ে আছেন কেনো ?

পথের শেষ প্যাসেঞ্জার ছিলেন আপনি

একটু পর-

ঝিঁঝিঁ ডাকবে

পেপার মিলের হুইসেল বাজবে

অতপর-

নিমুলাল বাঁশফোর বেরুবেন ঝাড়ু দিতে

ততোক্ষণে পৃথিবীর শেষ যাত্রীর বিদায় অনিবার্য

 

 উঁই পোকা উড়তে শুরু করেছে বেসামাল

ঝড় আসবে আর কিছুক্ষণ পর

সুতরাং

আপনি চলে যেতে পারেন

কারণ -

রাস্তা শেষ

গলির মাথায় আর কিছু নেই

যতোদূর জানি, পৃথিবীর শেষ এখানেই

অন্ধকারের নির্যাস গলে

যে আলোটুকুর জন্ম ভোরের আগে

তাতে আকাশ জ্বলে ওঠে গোপনে

আজও জেগে উঠেছে দ্বিপ্রহর

সুতরাং, আর দেরি নয়

রাস্তা শেষ,

দ্রুত যেতে পারেন গলির মাথায় ।

 

নিসঙ্গ লোকটি নিকটতম বন্ধুকে খুঁজলেন

অতপর

নিজেই দেখলেন মানুষের বিরস ছায়া

শুধু বললেন, অদ্ভুত

গলির মাথায় কোন গন্তব্য থাকে না

সব রাস্তা শেষ হয় অনন্তের রেখা ধরে

সুতরাং

আপনি যান আমি পরে আসছি

কিংবা থেকেই যদি যায় তাহলে

মহাকালের কী এমন ক্ষতি ?

 (২৬ আগস্ট ২০২৫, বরইচারা, খোকসা, কুষ্টিয়া)

 

অপভ্রংশ

 

ঘরের ভেতর

আস্ত একটা সাপ দেখতে চেয়ে

অপেক্ষা করি মাঝরাতে

অতপর

পোকা দেখি

ছাট পোকা, গোবরে পোকা, জলপোকা

তাহলে

দিনের আলোয় দড়ি দেখে ভরকে গেলাম কেনো ?

(২৬ আগস্ট ২০২৫, বরইচারা, খোকসা, কুষ্টিয়া)

 

তামাবিল পোড়ায় সুদূর

 

মোম জ্বলে

মোম গলে

আগরবাতির ঘ্রাণ শুনি

যখন

শ্বেতি দাগ পরা প্রজাপতি আসে

অনর্থক জ্বলে থাকা টিউবের গায়ে

কম্পানি জানেই না

মানুষ আলো চায়, বিরস ছায়া চায় না

শেষতক

অন্ধকারে হাঁটতেই স্বাচ্ছন্দ্য তার

ততোক্ষণ

আলোর বিনিয়োগ ছাডিয়েছে মনের বিলিয়ন

মোম গলে

রাতভর জ্বলে মোম

অথচ

গলিত মোমগুলো মথিত হয়ে অনর্থক 

জ্বলে ওঠে পুনরায় কিছুক্ষণ

এরচে বরং উত্তম আগরবাতি

ছাই হলে ঝরে পড়ে তক্তপোষে

স্মৃতিরা নিখাদ হয় না কোনদিন

ছায়া নিজেই সাক্ষ্য দেয়

আস্ত এক শরীরের কাছে

এখন খুশি আমি

আপনার সন্তুষ্টি ঘটলে

মোমকে বলি

আর যেনো আমাকে না পোড়ায় !

(২৬ আগস্ট ২৫, বরইচারা, খোকসা, কুষ্টিয়া)

 

সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত

 

লাইন সংস্কার চলছে

শেষ ট্রেন চলে গেছে কবে কে জানে?

লাল মানে নিষেধ

সিগন্যাল সারাক্ষণ

কিন্ত কে শোনে ?

 

আস্ত একটানা ট্রেন চালানোর দাবিতে

মিছিল মিটিং শেষে বিপ্লবী স্টেশন

এতোদিনেও চিনলে না বুকিং মাস্টার

প্র‌্যাটফর্মের শেষ কোণে ব্রিটিশের কৃষ্ণচূড়া

ফুল দেখে সিগন্যাল মেনেছে সেকেলে গার্ড সাহেব

পাইপ ফুঁকেছে শক্ত চেয়ারে বসে পাকশিফেরত ড্রাইভার

লাইনের সংস্কার কাজ চলছে

সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত

কথা আমার নয়

বলেছে কর্তৃপক্ষ

একদঙ্গল মানুষ

তবু

যাত্রী সেজে বসে আছে স্টেশনে

কিছু সংখ্যক

সংযোগ লাইনের জংশনে বসে

জলিল মিয়ার ওষুধের গুণ শোনে

অতপর মাসুম বাচ্চাটার পেটে ছোরা ঢুকিয়ে

আগুন ধরিয়ে দেয় মিহিন রুমালে

টাকা না দিয়ে যারা পকেটে রেখেছিল সাধের দস্তানা

ধর থেকে দেহ আলাদা করতেই কেউ একজন

ভিঁমড়ি খেয়ে পরে যায় খোয়ার ওপর

যেখানে দুটি লাইন বেঁকে গেছে পার্বতীপুর

শুকনো মরিচের ঘ্রাণ আসছে হিলি বর্ডার থেকে

নাক জ্বলছে

গুমটি ঘরটা সামান্য দূর

পেছনে হেঁকে-বকে অস্থির সুবল মহাজন

গোয়ালন্দের মাল উঠেছে পাঁচবিবির ঠিকানায়

ওদিকটায় লাইন সংস্কার চলছে

লাল সিগন্যাল মানে বারণ

ভয় নেই, কেউ যাবে না মরতে

যাত্রীর এমনই জীবন

(২৬ আগস্ট ২৫, বরইচারা, খোকসা, কুষ্টিয়া)

 

কলিযুগে বর্ণসমুচ্চয়

 

উঠোনের পুবকোণে একরত্তি কদবেল গাছ

তারই নিচে পাশাপাশি দুটি উনুন

জন্মের পর থেকে -

জ্বলতে জ্বলতে আমার মা ঘর হয়ে গেছেন

কাকা জ্যাঠারা একযোগে বললেন -

গৃহলক্ষী বেশ !

 

এক জনম পর-

মা পৃথিবীতে এলেন আমারই বোন হয়ে

গোস্বামী দাদু বললেন-মানুষ এভাবেই রূপ পাল্টায়

শক্তিরূপে আত্মা ফিরে আসে পরিবর্তিত প্রতিবেশে

জন্মান্তরবাদ শব্দটি পাড়ার মানুষের ঠিক মনে আসে না,

গীতার শ্লোক যেখানে থমকে গিয়েছে তিষ্ঠ ক্ষণকাল

শ্রুতিমধুর বইখানা সেলাইয়ের পুরোটা গ্রহণ করতে পারেনি

মোটা বইয়েরা সবাই ভ্রমরের ওপর রুষ্ট বটে

মোহিনী মিলের ম্যানেজার অন্নদা বাবু বলেছেন, ধর্ম বই এমনই হয়-

শুরু থেকে শেষ বলে কিছু নেই

অবরোহণ আরোহন কিংবা ওঠানামা

শ্লোকের সবটাই ক্লাইমেক্স

প্রতিটি অক্ষর একেকটি জীবনের মই

অবশ্য আরেকটি কারণও বিদ্যমান

মানুষের ভেদাভেদতত্ত্ব বোঝায় বয়স কোনদিনই হয়নি আমার

শুধু দেখেছি-

উঠোনের দক্ষিণ কোণে ভাগের চুলো

ভোরের শিশির নিংড়ে টুপটাপ শিউলী

আধো ঘুমে যেদিনই তাকায়-

বোন আমার ধান সিদ্ধ করতে শশব্যস্ত

বৃহদায়তন ডেকচির ভাঁজে

শেষরাতের কুয়াশা ম্লান হয়ে তাঁকে আচ্ছন্ন করে

মুগ্ধ সমীরণ উতরে প্রায়ই খুঁজি তাঁর চেনা চেহারা

কিন্ত মুখ কই?

গনগনে আগুন ঢেকে দিয়েছে নিষ্ঠুর গোল

কলাপাতা বৌ, বাড়ির সৌন্দর্য যাই বলো না কেনো

যে নামে সুখ পাও পুডিয়ে-পোড়ায়ে

পেতলে পোড়া মুখ তাঁর অবয়ব

চুলার সিঁথি পাশে আস্ত এক মানুষ !

 

চৈত্র সংক্রান্তির চার কার্যদিবস আগে

গণকঠাকুর এলেন পন্জিকা পড়তে

হঠাৎ ঝড়, ভাসানো বৃষ্টি দুমড়ে দিলো সব

স্নিগ্ধ সকালে গণকমশায় রওনা দেবার প্রাক্কালে

উনুন ফলানো বোনকে বলে গেলেন জীবন্ত দশভূজা

এক হাতে ধানসিদ্ধ, আরেক হাত অতিথির রান্নায়,

উঠোন ঝাড়ু, কোসন মাজা, বিড়ির আগুন গোজরান শীর্ণ শ্বশুরের

তাতেই মনে ধরে গণকের

প্রশংসাপত্র কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখা হলো খিড়কিবেড়ায়

বয়স বাড়লে শুনেছি, এই বোনটির নাকি পরজনম হয়নি

ওর বেলায়-

বটের ঝুরির মতো শাস্ত্র এসে মিশে গেছে হিরোন্ময় মাটিতে

কাজ ফাঁকির কারণে অথৈ সংসার

খুন করেছিল আগুনকে

ভোরের শিশির হয়ে যে কি না টুপটাপ

নিংড়ে দিয়েছিল গীতার পরমশ্লোক

নিষ্ঠ কর্মযোগ

বহুদিন পর বর্ণের কলিযুগে

কবিতা যখন লেখা হলো শব্দসমুচ্চয়

কবি একাই শুধু কাঁদলেন

বাকিরা নিশ্চুপ ছিলেন নিশ্চয়

(২৬ আগস্ট ২৫, বরইচারা, খোকসা, কুষ্টিয়া