
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শন ছিল—‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। এই নীতির আলোকে বাংলাদেশ শান্তি, মানবতা ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেন, এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এই অংশগ্রহণ অব্যাহত ও বিস্তৃত হয়েছে।
গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সেনাসদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে জীবন বাজি রেখে কাজ করছেন। আফ্রিকার রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, কঙ্গো, সুদান, দক্ষিণ সুদান, মালি, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, লেবানন থেকে শুরু করে হাইতি ও পূর্ব তিমুর পর্যন্ত—প্রায় সব মহাদেশেই বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে শান্তির বার্তাবাহক হিসেবে। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাজারো সদস্য জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন, যা বাংলাদেশকে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম শীর্ষ অবদানকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। জাতিসংঘ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শান্তিরক্ষা বাহিনীতে অবদান রাখা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে প্রথম সারিতে রয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা শুধু সামরিক শক্তির প্রতীক নন, বরং মানবিক সহায়তা, অবকাঠামো পুনর্গঠন, চিকিৎসা সেবা, নারী ও শিশু সুরক্ষা এবং স্থানীয় জনগণের পুনর্বাসনেও অবদান রাখছেন। তাদের শৃঙ্খলা, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। অনেক মিশনপ্রধান স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের উপস্থিতি মানেই সেখানে শৃঙ্খলা ও আস্থা ফিরে আসা। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বহুবার আত্মত্যাগের নজির স্থাপন করেছেন। শতাধিক সেনাসদস্য মিশন এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে জীবন দিয়েছেন—যাদের সম্মানিত করা হয়েছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পদকে। এই ত্যাগ ও সাহসিকতার মাধ্যমে বাংলাদেশের নাম বিশ্ব মানচিত্রে আরও উজ্জ্বল হয়েছে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের সৈনিক মানেই এখন নির্ভরযোগ্য, পেশাদার ও মানবিক শান্তিরক্ষী।
শান্তিরক্ষা অভিযানে নারী সেনাসদস্যদের অংশগ্রহণও বাংলাদেশের জন্য এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে। তারা মেডিক্যাল, লজিস্টিক, স্টাফ অফিসার কিংবা সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে যেখানেই কাজ করেছেন, সেখানেই সম্মান ও প্রশংসা অর্জন করেছেন। এই অন্তর্ভুক্তি শুধু জাতিসংঘের লিঙ্গসমতা লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং বাংলাদেশকে আধুনিক ও অগ্রসর সামরিক মানসিকতার উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কেবল আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত করেনি, বরং দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও এক গভীর দেশপ্রেম, মানবিকতা ও বৈশ্বিক দায়িত্ববোধের চেতনা সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে বলেছে, তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জনেও অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই অসামান্য অবদান প্রমাণ করেছে—একটি ছোট দেশও যদি দৃঢ় সংকল্প ও মানবিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়, তবে সে বিশ্বে শান্তির অন্যতম নেতৃত্বস্থানীয় শক্তি হয়ে উঠতে পারে। বিশ্বমঞ্চে আজ বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয় শান্তির প্রতীক হিসেবে—এ গৌরব বাংলাদেশের প্রতিটি সেনাসদস্যের রক্ত, ঘাম ও আত্মত্যাগে গড়ে ওঠা।