সোমবার,

১৩ অক্টোবর ২০২৫

|

আশ্বিন ২৮ ১৪৩২

XFilesBd

তুমি কি কোন আওয়াজ পেয়েছিলে নাকি? 

আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি

প্রকাশিত: ০১:২৩, ৬ অক্টোবর ২০২৫

তুমি কি কোন আওয়াজ পেয়েছিলে নাকি? 

রাশিয়ান তিনটা যুদ্ধ বিমান এস্তোনিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে উড়ে চলে গেছে। যেই দেশটাতে আমি গত ১৩ বছর ধরে থাকছি। সুইডেনে পড়াশুনা করার সময়ই এই দেশটা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম। ২০০৬ সালে একটা প্রাসাদসম জাহাজে করে স্টকহোম থেকে তাললিনে এসেছিলাম ঘুরতে। তাললিন এস্তোনিয়ার রাজধানী। 

দেশটি এত ভালো লেগে গিয়েছিলো যে, এরপর ইংল্যান্ড থেকে পিএইচডি করে এস্তোনিয়াতেই ফিরে এসেছিলাম চাকরি করতে। মাত্র ১৩ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ, সেনজেনভুক্ত এবং ন্যাটোর সদস্যও বটে। 

১৯৯১ সালে রাশিয়া থেকে স্বাধীন হবার পর খুব দ্রুত ওরা এগিয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর প্রথম ই-কান্ট্রি। এরাই জগতে সবার প্রথম অন-লাইনে জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। আমাদের সিগনেচারও এখানে ডিজিটালাইজড। অর্থাৎ বাংলাদেশে বসেও আমি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল সাইন করতে পারবো। অনেকবার করেছিও। 

বর্তমানে পৃথিবীর এক নাম্বার পরিছন্নতম দেশ এটি। অন্যদেশের নাগরিকরা চাইলেই এই দেশের ই-রেসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে। এখানে একটা কোম্পানি খুলতে ১০ মিনিটের বেশি লাগে না। অন-লাইনেই সব করে ফেলা যায়। এমন আরো নানান বিচিত্র ব্যাপার-স্যাপার আছে। আর আমাদের শহরে তো গণ পরিবহণ সম্পূর্ণ ফ্রি। শিক্ষা-চিকিৎসা এইসব তো ফ্রি বটেই। 

তো, এই দেশে তেমন কিছু ঘটে না। মানে পত্রিকাগুলোকে দেখি মাঝে মাঝেই শিরোনাম করে- অমুক বাড়ির মালিক তাঁর কুকুরকে ঠিক মত যত্ন নিচ্ছেন না বলে জরিমান করা হয়েছে ইত্যাদি। 

আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না বেশ কিছু দিন ধরে। সেদিন পর্তুগাল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছিলাম। ক্লাস রুমেই অসুস্থ হয়ে গেলাম। ক্লাসটা না নিয়েই ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতে হয়েছে। আজ সকালে গিয়েছি হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে। দেখি সবাই খুবই উত্তেজিত! ঘটনা বুঝার চেষ্টা করছিলাম। এর মাঝে ইমারজেন্সি ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করেছে 

- তুমি কি কোন আওয়াজ পেয়েছিলে নাকি? 

আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না-  সাদা চামড়া, নীল চোখের এই মাঝ বয়সি ডাক্তার কিসের আওাজের কথা বলছে! জিজ্ঞেস করলাম 

- কিসের আওয়াজের কথা বলছো?
- রাশিয়ান ফাইটার জেটের আওয়াজ। 
- কেন কী হয়েছে?
- তুমি জানো না কিছু?
- না তো!

এইবার ডাক্তার খুব উত্তেজিত হয়েছে বলেছে 

- তিনটা রাশিয়ান ফাইটার জেট আমাদের বালটিক সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে চলে গেছে! চিন্তা করতে পারো! আমরা তো ন্যাটো সদস্য। এত বড় সাহস ওরা পায় কী করে? 

আমি একটু হেসে বললাম 

- আমার বাসা তো বালটিক সমুদ্রের উপরে না। তাই শুনতে পাইনি।

এবার ডাক্তারও হাসে, আমিও হাসছি। চলে আসার সময় মনে হলো- এই দেশের মানুষরা অন্তত কিছু নিয়ে আলোচনা করার বিষয় খুঁজে পেয়েছে। এখানে তেমন কিছু ঘটেই না। আমার সহকর্মীদের সাথে সপ্তাহে একদিনও ঠিক ভাবে কথা হয় না। ইউনিভার্সিটিতে যাই। খুবই ছোট্ট বিশ্ববিদ্যালয়। ছোট্ট একটা জায়গা। এরপরও কথা হয় না। 

যে যার কাজ করছে। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। আমি যাই, ক্লাস নেই; এরপর আবার চলে আসি। তবে এই সপ্তাহটা মনে হচ্ছে এদের হুইসপার করেই কেটে যাবে। একজন আরেকজনকে বলবে- "শুনেছ নাকি ঘটনা?" 

পরের বার কেউ এই ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ভাবছি বলবো- আমাদের বাংলাদেশে একটা প্রবাদ আছে- অ্যামেরিকা যার বন্ধু হয়, তাঁর শত্রুর অভাব হয় না।

[ লেখক: আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি [email protected] ]