
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ওপর সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবাদ সভা করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ। কথিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ধাপে ধাপে তা কিভাবে বৈষম্যমূলক আন্দোলনে রূপ নিলো তা উঠে আসে নিউ ইয়র্ক-জ্যাকসন হাইটসের জুইস সেন্টারে অনুষ্ঠিত আলোচনায়। যেখানে হিন্দু নারীদের সম্ভ্রমহানি, বাড়িঘর লুটপাট ও জ্বালাও পোড়াও, ধর্ষণ, জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল, মব সৃষ্টির মাধ্যমে মারধোর করে চাকরি থেকে অব্যাহতিসহ নানা বিষয় উঠে আসে। নিউ ইয়র্কের কমিউনিটি লিডার বিশিষ্ট এটর্ণি অশোক কর্মকারের তত্ত্বাবধানে সে অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ আমলসহ বিভিন্ন সময়ে হিন্দু নির্যাতনের বিস্তর তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন বাংলাদেশ হতে নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞ এটর্ণি অশোক কর্মকার এ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন কীভাবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশের সবচেয়ে বৈষম্যমূলক হয়ে উঠলো। যার ভয়ঙ্কর প্রভাব এখনও হিন্দু কমিউনিটির ওপর সরাসরি বিদ্যমান। সরকার জানছে, জানানো হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে তারপরও সবাই চুপ। এতেকরে হিংস্র একটি জাতিগোষ্ঠী দেশটিতে অল্পদিনের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। প্রতিবাদ আলোচনার মাঝে এটর্নি অশোক কর্মকারের ভাবনা, স্ক্রিপ্ট রাইট এবং নির্দেশনায় বাংলাদেশের নির্যাতিত ও প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া গণমাধ্যমকর্মী শিউলী সিকদার এর সহকারী নিদর্শনায় ও সম্পাদনায় একটি ডকুমেন্টারি দেখানো হয়। যেখানে বিভিন্ন সরকারের আমলে হিন্দুদের ওপর জুলুম অত্যাচার ও বর্তমান ইনটেরিম সরকারের জ্বালাও পোড়াও দমন নীতির চিত্র প্রতিফলিত।
অনুষ্ঠানে ১৯৯৪ সালে দেশ ছাড়া নির্বাসিতা লেখিকা তসলিমা নাসরিন মানবাধিকার রক্ষায় দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন সংগঠনের সহযোগিতা কামনা করে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ডক্টর ইউনূস সরকার যেটি করছে তা রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো। এটি এখনই থামানো না গেলে অল্পদিনেই ঘটনাগুলো একাত্তরকেও ছাড়িয়ে যাবে। বেশ কিছু ঘটনা পাকিস্তানবাহিনীকেও হার মানিয়েছে। ইনটেরিম সরকারের স্নেহপুষ্ট বাহিনী দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা করছে। তাঁর অভিমত, এই অল্পসময়ে বাংলাদেশে কুসংস্কার বেড়েছে, বেড়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামি। রাস্তাঘাটে নারী-বৃদ্ধ-শিশু অবদমিত হচ্ছে। সিঁদুর পড়তে পারছেন না হিন্দু মা-বোনেরা। এমনকি টিপ পড়তেও ভয় পাচ্ছেন। নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। অনুষ্ঠান শেষ করে নিজের ফেসবুকে লেখেন- ‘‘বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, ইউ এস এর অনুষ্ঠানে গতকাল আমি উপস্থিত ছিলাম। 'ইয়াহিয়া টু ইউনুস' নামে একটি তথ্যবহুল ডকুফিল্ম দেখেছি। এবং এ নিয়ে অনলাইনে এবং অফলাইনে কয়েকজন গবেষকের বক্তব্য শুনেছি। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী বিস্তারিত শোনা হলো। মানসম্মত এই অনুষ্ঠানের ভিডিও আছে মন্তব্য কলামে।’’ পুরো আনুষ্ঠানিকতার তত্ত্বাবধানকারী কমিউনিটি লিডার ও বিশিষ্ট আইনবিশেষজ্ঞ অশোক কুমার কর্মকার বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিকটিমদের সাথে কথা বলে প্রত্যেকের সমস্যা ধরে ধরে আমরা প্রকৃত ঘটনা জানান দিব। কিন্তু প্রাণের ভয়ে ৯৯ শতাংশ ব্যক্তি মুখ খোলেনি। তারা নিজের ছবি দেখাতে ও কথা বলতেও ভয় পান। প্রতিদিন হিন্দুরা সেখানে নিগৃহীত হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে, বাড়ি জ্বালানো হচ্ছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট হচ্ছে কিন্তু বিচার পাচ্ছে না। অদ্ভুত এক বিচারব্যবস্থা সেখানে চলমান। বিস্ময়কর এক রাষ্ট্রব্যবস্থা বিদ্যমান বাংলাদেশে। সুতরাং আমরা অল্পস্বল্প ঘটনা তুলে ধরতে পেরেছি, শীঘ্রই বাকিটা বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দিতে পারব আশাকরি।
অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন সমাজবিশেষজ্ঞ তথাগত রায়, পদ্মা কুপা , রুমা সরকার প্রমুখ। সরাসরি বক্তব্য দেন কমিউনিটি লিডার মৃম্ময় সমাদ্দার, গীতা চক্রবর্তী , পলাশ বড়ুযা, প্রফেসর চন্দন সরকারসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ এবং কয়েকজন ভিকটিম। বক্তারা বলেন, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু হিন্দু জনগোষ্ঠীর পক্ষে সে বিজয় শীঘ্রই বিশ্বাসঘাতকতায় পরিণত হয়। এমনকি ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে সাম্যতার আন্দোলন হিসেবে যা শুরু হয়েছিল তা অল্পদিনেই নিপীড়ন ও দমন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ গণহত্যার সাক্ষ্য হতে চলেছে ইনটেরিম সরকারের গণবিরোধী ব্যবস্থা। দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজ অব্দি কিভাবে সমাজের বিভিন্ন পেশা ও প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের হিন্দুরা নির্যাতিত ও নিষ্পেষনের শিকার হয়েছে তার ব্যাখ্যা তুলে ধরেন এটর্ণি অশোক কর্মকার। তাঁর অভিমত, ১৯৭৫ থেকে ২০১০ অব্দি বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। শেখ হাসিনার আমলেও হিন্দু তাড়াও আন্দোলন অব্যাহত ছিল। কৌশলগতভাবে মুষ্টিমেয় হিন্দুদের বিশিষ্ট পদে নিয়োগ করেছিলেন তিনি। সেটি ছিল হাসিনার নিজেস্ব কৌশল মাত্র। আর ইউনূসের ইনটেরিম অগুণতি হিন্দুকে মিথ্যা কারাবাস, নির্বাসন ও নির্য়াতনের মধ্যে রেখেছে। এডভোকেট পলাশ রায়কে পুড়িয়ে হত্যা, ধর্ম অবমাননার ঝাণ্ডা তুলে চারজনকে পিটিয়ে হত্যার চিত্র তুলে ধরে কিভাবে কাকে কোথায় কতোটা নির্মমভাবে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছে এবং হচ্ছে সেসব চিত্র তুলে ধরেন আমেরিকান আইনবিশেষজ্ঞ অশোক কর্মকার।