
ঈদুল আজহার আগের দিন ও রাতে মহাসড়কে বেড়েছে পরিবহনের চাপ। বৃহস্পতিবার দিন পেরিয়ে রাত শেষ হলেও যানবাহনের চাপ কমেনি। বরং শুক্রবার সকালেও চাপ আরও তীব্র হয় কোথাও কোথাও। পরিবহন চালকেরা বলছেন, মহাসড়ক কিছুটা ফাঁকা হবে দুপুরের পর থেকে। শুক্রবার সন্ধ্যায় হালকা চাপ থাকবে তবে রাতে আবার কমবে। ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের গাজীপুরের কালিয়াকৈর চন্দ্রা মোড় থেকে কোনাবাড়ী এবং বাইপাইল পর্যন্ত বিকেল থেকে যানজট তৈরি হয়েছে। রাত ২ টার পর এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও রাস্তার দু’পাশে প্রায় আটকিলোমিটার দীর্ঘ যানজট ছিল। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় ১০ কিলোমিটার পথে ছিল ধীরগতি। গাড়ির চাপ বাড়ায় ভোগান্তি ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর অংশে। গভীর রাতে সবচেয়ে বেশি গাড়ির চাপ বেড়েছে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ১৫ কিলোমিটার যানজট
শিল্প অধ্যূষিত গাজীপুর থেকে স্বজনদের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে ইতিমধ্যে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন লাখা মানুষ। পরিবহন সংকট ও অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ময়মনসিংহগামী লেনে ১৫কিলোমিটার এলাকায় যানজট তৈরী হয়েছে। দিনেও থেমে থেমে যানজট পর্যায়ক্রমে বড় আকার তৈরী হয়েছে। শ্রীপুরের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি এলাকা থেকে ভালুকার সীডস্টোর-আমতলী পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকায় যানজট রয়েছে। মাওনা এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানা প্রতিদিনই ১২কিলোমিটার দুরে ভবানীপুর এলাকায় অফিস করেন। এই ১২কিলোমিটার পথ তিনি ১৫ থেকে ২০মিনিটের মধ্যে পাড় হোন।
ঈদ যাত্রায় আড়াই ঘন্টায় মাত্র ৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন সানজানা ইব্রাহিম। তিনি বলেন, প্রায় আড়াই ঘন্টার মত গাড়িতে বসে আছি। আমার চাইতে বেশি ভূগছে ঈদে ঘরে ফেরা সাধারণ মানুষ, নারী যাত্রী ও বিশেষ করে শিশুরা।
মহাসড়কের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর চাইতেও মহাসড়কে চলাচল নির্বিঘ্ন করতে বাস চালক ও সহকারীদের সচেতনতা জরুরী। মাওনা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আইয়ুব আলী বলেন, ময়মনসিংহের ভালুকার সীড স্টোরে দুপুরের পর থেকে যাত্রী ও যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ বাড়ে। রাতে সেটি তীব্র হয়। ময়মনসিংহ ফুলবাড়িয়ার বাসিন্দা মাহবুব হোসেন বলেন, আল্লার নাম নিয়ে চললাম। যখন যেভাবে পৌঁছায় সমস্যা নেই। তবে প্রাইভেট গাড়ির গ্যাস কখন ফুরিয়ে যায় এ নিয়ে টেনশনে আছেন তিনি। কারণ যেখাকে তেল গ্যাস শেস হবে তার পাশেপাশে ফুয়েল স্টেশন না থাকলে তো মাথায় বাড়ি। ফ্যামিলি নিয়ে গাড়ি ঠ্যালাও সম্ভব নয়।
বিকেলে ঈদ যাত্রায় হানা দেয় বৃষ্টি। বৃষ্টির সময় অনেক বাস যাত্রী তুলতে পারেনি। দীর্ঘ সময় তারা মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। একারণে মোড়ে মোড়ে যানজটের তৈরী হয়েছে। সেই যানজট এখন কয়েক কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ যানজট নিরসনে কাজ করছে।
অতিরিক্ত যানবাহনে ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কে তীব্র যানজট
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া এ যানজট সকালে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই জানান রংপুরের যাত্রী নূর মোহাম্মদ জনি। ঢাকার একটি ম্যানপাওয়ার প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মিস্টার নূর মোহাম্মদ বলেন, ফ্যামিলি নিয়ে আগে যেতে পারেন নি কারণ তাঁর প্রতিষ্ঠানের সবাইকে বেতন বোনাস দিয়ে নিজের সবকিছু গোছাতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। যে কারণে সন্ধ্যায় রওনা দিয়ে তাদের পৌছাতে কতোক্ষন লাগবে তা বলা মুশকিল। তাঁর উত্তরা কামারপাড়া বাসা থেকে বের হয়েই যানজটের শিকার হয়েছেন তিনি। থেমে থেমে যাচ্ছে তাদের গাড়ি। স্ত্রী অসুস্থ বিধায় বিশেষ বিচলিত মিস্টার নূর মোহাম্মদ। তাঁর আশা শুক্রবার দুপুরের মধ্যে রংপুরে পৌঁছাতে পারবেন।
কালিহাতি থানার ওসি তদন্ত মিজানুর রহমান বলেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানজট কমে আসবে। গোড়াই হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম জানান, চন্দ্রা থেকে সৃষ্ট যানজট নিরসনে পুলিশ ও সেনাবাহিনী কাজ করছে। আস্তে আস্তে যানজট কমে আসছে। রাত ২ টার পর এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত যমুনা সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে আশেকপুর বাইপাস পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এছাড়া গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে মির্জাপুর উপজেলার ১৭ কিলোমিটার এলাকায় গতকাল ভোর রাত থেকেই থেমে থেমে যানজট দেখা দিয়েছে।
যানজট তবু বাড়তি বাড়া ঢাকা পাটুরিয়া মহাসড়কে
আজ দুপুর থেকে শুরু হয়েছে ১০ মাইলের দীর্ঘমযানজট। সাভার ও আশেপাশের শিল্প এলাকা থেকেও রওনা হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। তাদের বেশিরভাগই তৈরি পোশাক শ্রমিক। তবে পথে তাদের পড়তে হয়েছে তীব্র যানজটে, সঙ্গে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়াও। যানবাহন ও যাত্রীর সংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধির কারণে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা এবং নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কে তীব্র যানজটের খবর পাওয়া গেছে।
সকাল থেকে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, যা যাত্রীদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। ঈদের কারণে বাড়তি যাত্রীর চাপের সুযোগ নিয়ে পরিবহন শ্রমিকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যাত্রীদের স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে। অনেক যাত্রীকে কেবল জায়গা নিশ্চিত করার জন্য অনেক বেশি ভাড়ায় আসন বুক করতে দেখা গেছে। সকাল থেকেই সাভার এবং আশেপাশের এলাকার পরিবহন কাউন্টারগুলোতে দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। হেমায়েতপুর, আমিন বাজার, গেন্ডা, উলাইল, নবীনগর, বাইপাইল, শ্রীপুর এবং জিরানী বাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যাত্রীরা আসনের অভাব এবং টিকিটের মূল্য বেশি বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী। যশোরগামী আরেক যাত্রী পলাশ মাহবুব বলেন, ‘তারা ৭০০ টাকার টিকিটের জন্য ১২০০ টাকা দাবি করছে। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের কী করার আছে?’ বাসচালক জনি জামান অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা কাউকে জোর করছি না। কিছু যাত্রী স্বেচ্ছায় ঈদ বোনাস দিচ্ছেন।’ বরিশাল রুটের সাকুরা পরিবহনের সুপারভাইজার সুব্রত কুমার দাবি করেছেন যে, তারা নিয়মিত ভাড়া নিচ্ছেন তবে উচ্চ চাহিদার কথা স্বীকার করেছেন। ‘আসন সীমিত এবং ঈদের সময় খরচ সবসময়ই বেড়ে যায়।’
রাজবাড়ি পাংশার যাত্রী রত্না আহমেদ বলেন, দুপুর ১২টায় কাঠালবাগানের বাসা থেকে রওনা দিয়ে রাত ১১টায় ফেরি পার হতে পারেন নি। সারা রাস্তা পিটপিট করে গাড়ি চললেও শুধু পাটুরিয়া ঘাটের এক কিলোমিটার পাড়ি দিতে লেগেছে ৩ ঘন্টা। মহাদেরপুর থেকে সন্ধ্যা লেগেছে। আর ফেরি পার হলেন ১১ টায়। ওদিকে সুযোগ বুঝে লণ্চ বন্ধ করে দিয়েছে ঘাট কতৃপক্ষ। আর এ কারণেই লণ্চের সব যাত্রী যাচ্ছেন ফেরিতে। চরম এক বাজে পরিবেশ তৈরী হয়েছে পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে।
চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজট ১৮ কি.মি.
চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকায় প্রায় ১৫ কিলোমিটারের দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর শুরু হলেও গভীর রাতে এ যানজট সীমা ছাড়িয়ে যায়। এতে ঈদ উদ্যাপনে বাড়ি ফেরা যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। হাইওয়ে পুলিশ বলছে, সকালে একটি দুর্ঘটনার কারণে এ দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। চালকেরা বলছেন, পুলিশের পর্যাপ্ত তদারকি না থাকায় এ ঘটনা ঘটেছে।
সীতাকুণ্ডের বার আউলিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মুমিন বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভাটিয়ারী এলাকায় ঢাকামুখী লেনে একটি ট্রাকে পেছন থেকে দুইটি গাড়ি একের পর এক ধাক্কা দেয়। এতে কিছু সময়ের জন্য যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী হাইওয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গাড়িগুলি সরিয়ে নেয়। সকাল ১১টার দিকে যান চলাচল আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু রাতে এতোটাই বাড়ে যে আমরা খেই হারিয়ে ফেলছি।
ভাটিয়ারী পোর্টলিংক, শীতলপুর বিএম কন্টেইনার ডিপো, কুমিরায় কেডিএস ডিপোসহ বেশ কয়েকটি কন্টেইনার ডিপো এলাকায় যানবাহনের দীর্ঘ জট দেখা গেছে। তবে ঢাকা থেকে কুমিল্লার হোমনা পৌঁছাতে মোটরবাইকে মাত্র আড়াই ঘন্টা লেগেছে বলে জানিয়েছেন কর্মজীবী সাইজুদ্দিন। ঢাকার বাংলামোটর থেকে তিনি সকালে রওনা দিয়েছিলেন। তখন রাস্তায় থেমে থেমে গাড়িগুলি যাচ্ছিল। কিন্তু তার সাথে বাইক থাকায় তিনি কোণা ধরে চিপা উতরে গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছেন।
দক্ষিণের যাত্রীদের ভোগান্তির নাম পদ্মা সেতুর টোল
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সড়কপথে চলাচল নির্বিঘ্ন হলেও ঈদের মৌসুমে কিছুটা ভোগান্তি বাড়ায় পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজা। অন্যদিকে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে স্বস্তিতে যাতায়াতের সুযোগ থাকলেও এর টোলপ্লাজায় কয়েকগুণ চাপ বাড়ছে। ফলে পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে যারা পদ্মা সেতু দিয়ে যাচ্ছেন তাদের দুই দিকের টোলপ্লাজার যানজটে পড়তে হয়েছে।
গত রাতে এই পথে যেতে সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে যেসব গাড়ি ফ্লাইওভার দিয়ে ঢাকা ছেড়েছে তাদের বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে টোলপ্লাজায়। এদিকে পবিত্র ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। এবার সরকারি চাকরিজীবীদের লম্বা ছুটি। বেসরকারি চাকরিজীবীদেরও অতীতের তুলনায় ছুটি কিছুটা বেড়েছে। ফলে আগে ঈদের আগের দিন রওনা হওয়ার সুযোগ পেতেন অনেকে। তারপরও কেনো এতোটা যানজট তার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না হাইওয়ে পুলিশের কর্তারা। তবে এবার অন্তত দুদিন-একদিন আগে গ্রামে যেতে পারছে লোকজন। যে কারণে বৃহস্পতিবার রাতের চাপটা অনেক বেশি লক্ষ্য করা গেছে।