শনিবার,

০৭ জুন ২০২৫

|

জ্যৈষ্ঠ ২৩ ১৪৩২

XFilesBd

ব্রেকিং

২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থ-উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। মোট বাজেট -৭,৯০,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা-৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি -২,২৬,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬%) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা-৫

ডিপ স্টেট (Deep State) আসলে কী ?

ড. অখিল পোদ্দার (Dr. Akhil Podder)

প্রকাশিত: ২২:১৩, ৫ জুন ২০২৫

আপডেট: ০৫:৩৬, ৬ জুন ২০২৫

ডিপ স্টেট (Deep State) আসলে কী ?

বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন পরবর্তী বেশ কিছু শব্দ যোগ হয়েছে নিত্যদিনের কথাবার্তায়। প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্রদের সভা-সমাবেশ, বিপ্লবীদের সেমিনার, উপদেষ্টাদের সাধারণ বক্তব্য ও গণমাধ্যমকর্মীদের লেখা-বলায় এসব শব্দ হরহামেশাই শোনা যাচ্ছে। কেউ বোঝেন কেউবা অল্পস্বল্প অর্থ জানেন অপ্রচলিত এসব শব্দের। কিন্তু কেনো, কোন নিরীখে কালের আবর্তে যুক্ত হলো এসব শব্দ তারই অনুসন্ধান করেছেন সাংবাদিক ড. অখিল পোদ্দার। নতুনভাবে প্রচলিত এসব শব্দের ব্যাখ্যা-বিশদ জানাবেন ড. পোদ্দার। আজকের বিষয়: মার্কিন ডিপ স্টেট।  

 ডিপ স্টেট (Deep State) আসলে কী?

শিক্ষিতমহল ছাড়া বাংলাদেশের সর্বসাধারণের মধ্যে ডিপ স্টেট শব্দটি একেবারেই ছিল অপরিচিত। জুলাই আন্দোলনে রেজিম চেঞ্জের পর থেকে সর্বসম্প্রদায়ের মধ্যে মার্কিন ডিপ স্টেট শব্দটি জোরেশোরে আলোচনায় স্থান পায়। বাংলাদেশের উলটপালট পরিবর্তন, সাম্প্রতিক সংঘটিত বহুবর্ণিল ঘটনা ও ডামাডোলের আগে-পিছে মার্কিন ডিপ স্টেটের হাত রয়েছে-এমনটাই বিশ্বাস করেন এদেশের অনেক মানুষ। বিশেষ এই শব্দটি ইদানীং উচ্চারিত হচ্ছে সর্বমহল তথা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিম্পোজিয়ামসহ গঞ্জের চায়ের দোকানে। কিন্তু ‘ডিপ স্টেট’ আসলে কী?

এটি এমন এক ধারণা বা তত্ব যা রাষ্ট্রের ভেতর অদৃশ্য-অপ্রকাশিত এক শক্তির জানান দিতে চায়। সরকার নির্বাচিত কর্মকর্তা কিংবা জনগণের ইচ্ছার বাইরে থেকেও ক্ষমতার পরিচালন করে এই থিংক ট্যাংক। সাধারণত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, আমলাতন্ত্র কিংবা কর্পোরেটের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে তারা আকাঙক্ষার প্রতিফলন ঘটায়।  

সাধারণত শব্দটি (মার্কিন ডিপ স্টেট) ব্যবহৃত হয় এমন এক ধারণা বোঝাতে, যেখানে একটি দেশের নির্বাচিত সরকার ছাড়াও স্থায়ী অদৃশ্য ক্ষমতাকাঠামো কাজ করেযা মূলত আমলাতন্ত্র, গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক বাহিনী এবং কর্পোরেট স্বার্থের সমন্বয়ে গঠিত।

এসব গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে সরকার পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক কূটনীতি বা গোপন অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম। এই গোষ্ঠীগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাইরে কাজ রে। অনেকটা ছায়া সরকারের মতো। এটি মূলত: অদৃশ্য অথচ শক্তিশালী ক্ষমতা কাঠামো, যা নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের বাইরেও দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন প্রয়োগে সক্রিয় থাকে। এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:

•        CIA (Central Intelligence Agency)

•        NSA (National Security Agency)

•        Pentagon (Military leadership)

•        State Department-এর গভীর প্রভাবশালী সেকশন

•        Arms industry এবং কর্পোরেটের প্রভাবশালী লবি

  •        Think tanks (Brookings, RAND, Atlantic Council ইত্যাদি)

            (Big Tech, Military-Industrial Complex) কর্পোরেটের বৃহৎ লবি

   •        ওয়াল স্ট্রিট ব্যাঙ্কিং এলিট

 

ডিপ স্টেট সম্পর্কে ইতিহাস কী বলে?  

ডিপ স্টেটের ধারণা নতুন মনে হলেও ইতিহাসে এর আস্ফালন বেশ আগের। এ শব্দের প্রথম ব্যবহার হয়েছিলো তুরস্কে-১৯২৩ সালে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর দেশটির ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রকাঠামো ধরে রাখার চেষ্টা হিসেবে সামরিকগোয়েন্দা, আমলাতন্ত্র ও গোপন নেটওয়ার্কে প্রথমবারের মতো গড়ে উঠে সমান্তরাল ছায়া রাষ্ট্র।

১৯৫০ সালে মার্কিন মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ধারণার সাথে ডিপ স্টেট তত্বকে প্রায়ই তুলনা করা হয়। অনেকের ধারণা, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই, সিআইএ ও সামরিকগোয়েন্দা সংস্থাগুলো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করে। যাদের উদ্দেশ্য:

ক. আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখা

খ. কর্পোরেট নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষা

গ. বন্ধুবান্ধব বা জ্বি হুকুম টাইপের সরকার কায়েম রাখা

ঘ. প্রবল বিরোধী ও তাদের মিত্রদের (বিশেষ করে চীন-রাশিয়া ঘনিষ্ঠদের) দুর্বল করা

মার্কিন ডিপ স্টেট তাহলে কীভাবে কাজ করে?

ডিপ স্টেট প্রভাবশালী কর্পোরেশন, গোয়েন্দা সংস্থা ও ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাব বিস্তার করে। গোপনে নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপর প্রভাব বিস্তার করে৷ যাতে করে তারা ডিপ স্টেট ব্যক্তিদের ইচ্ছা মতন কাজ করে৷ জনগণের মনোভাব এবং ধারণা প্রভাবিত করতে গণমাধ্যম, প্রোপাগাণ্ডা ও ইনফ্লুয়েন্সার এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক মাধ্যমকেও ব্যবহার করে। তত্ত্বটি সরকারি অনুমোদন ছাড়াই সরকারের ওপর গোপন নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেয়। ডিপ স্টেটকে সরকারি এবং বেসরকারি স্বার্থের মিশ্রণ হিসেবে দেখা হয়-যারা প্রভাব বিস্তার করে। কেউ কেউ অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি গভীর রাষ্ট্রের দাবি সমর্থন করার জন্য ফাঁস এবং বিরোধিতার মতো পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন।

এটি সত্য, যে যেভাবেই ডিপ স্টেটের ব্যাখ্যা কিংবা সংজ্ঞা দেন না কেনো এর সঙ্গে সবসময়ই গভীর এক চক্রান্ত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আর এই আকর্ষনীয় শব্দের বলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র, নেতা কিংবা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী আর কুটনীতিক। সুতরাং মোটা দাগে এটি অতি উন্নততর গভীর এক সাম্রাজ্যবাদ ও ‘‘ঘাড় ধাক্কা’’ নীতি। ইতিহাস সমসাময়িক বাস্তবতা বলছে, মার্কিন ডিপ স্টেট বা গভীর রাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে সরকার পতন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং রেজিম চেঞ্জ (Regime Change) প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রেখেছে। ইরান, চিলি, আফগানিস্তান, ইরাক বা লিবিয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন হস্তক্ষেপ এর উদাহরণ।

. ইরান (১৯৫৩ ) : প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক তেল জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন। CIA ব্রিটিশ MI6 একত্রে অপারেশন AJAX” চালিয়ে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। শাহ্ রেজা পাহলভীকে ক্ষমতায় বসায়একজন স্বৈরশাসক, কিন্তু পশ্চিমের বন্ধু-তাই।

. চিলি (১৯৭৩ ) : সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আয়েন্দেকে সরিয়ে জেনারেল পিনোচেটকে ক্ষমতায় বসানো হয়। CIA সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল এই সামরিক অভ্যুত্থানে।

. গুয়াতেমালা (১৯৫৪ ) : প্রেসিডেন্ট জ্যাকোবো আরবেনজ কৃষি সংস্কার করেনযা যুক্তরাষ্ট্রের United Fruit Company-এর স্বার্থে আঘাত হানে। CIA দ্বারা পরিচালিত কুখ্যাত অভ্যুত্থান তাকে সরিয়ে দেয়।

. ইন্দোনেশিয়া (১৯৬৫ ) : দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা সুকর্ণ কমিউনিস্ট-ঘেঁষা হিসেবে বিবেচিত হন। সামরিকবাহিনীর প্রধান সুহার্তোর ভয়াবহ এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কমিউনিস্টদের বধ্যভূমিতে তৈরি হয় দেশটি (১০ লাখ হত্যাকাণ্ড)

. লিবিয়া (২০১১ ) : কর্নেল গাদ্দাফির বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো হস্তক্ষেপ করে। তাকে হত্যা করা হয় চরম অস্থিরতায় পড়ে লিবিয়া।

. ইরাক (২০০৩ ) :  “WMD (Weapons of Mass Destruction)” নামক মিথ্যা অজুহাতে মার্কিন বাহিনী সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করে। বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাসবাদ বং আএএস-এর উত্থান ঘটে।

. ইউক্রেন (২০১৪ ) : নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ রাশিয়া ঘেঁষা ছিলেন। মার্কিন সহায়তায় ইউরোমাইদান আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে প্রো-ইউরোপ সরকার কায়েম করা হয়।

এসব ঘটনায় ডিপ স্টেট-এর ভূমিকা অস্বীকার করা সার্বিকভাবে বেশ মুশকিল। সুতরাং গভীর রাষ্ট্রের ধারণা -যাকে "রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র" বা ছায়া সরকার বলা যায়। আর এটি প্রথমে তুরস্ক এবং পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী রাশিয়ার মতো দেশগুলির রাজনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৫০-এর দশকে তুরস্কের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে একটি প্রভাবশালী গণতন্ত্রবিরোধী জোট "ডেরিন ডেভলেট’’ যার আক্ষরিক অর্থ "গভীর রাষ্ট্র" - প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মুস্তফা কামাল  আতাতুর্ক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নতুন তুর্কি প্রজাতন্ত্র থেকে কমিউনিস্টদের উৎখাতের জন্য নিজেদের সর্গ করেছিল বলে অভিযোগ। তুর্কি সামরিক, নিরাপত্তা এবং বিচার বিভাগীয় শাখার উপাদানগুলির সমন্বয়ে গঠিত, ডেরিন ডেভলেট "ফলস ফ্ল্যাগ" আক্রমণ এবং পরিকল্পিত দাঙ্গা পরিচালনা করে তুর্কি জনগণকে তার শত্রুদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার জন্য কাজ করেছিল। শেষ পর্যন্ত, ডেরিন ডেভলেটকে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছিল। ১৯৭০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাক্তন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পশ্চিমা বিশ্বে চলে যাওয়ার পর প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, সোভিয়েত রাজনৈতিক পুলিশ-কেজিবি একটি গভীর রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করেছিল। যারা গোপনে কমিউনিস্ট পার্টি এবং শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিল। ২০০৬ সালের এক সিম্পোজিয়ামে কমিউনিস্ট রোমানিয়া গোপন পুলিশের একজন প্রাক্তন জেনারেল যিনি ১৯৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়েছিলেন-ইয়ন মিহাই পেসেপা বলেছিলেন, "সোভিয়েত ইউনিয়নে, কেজিবি ছিল একটি রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র।" পেসেপা আরও দাবি করেন, "এখন প্রাক্তন কেজিবি অফিসাররা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। তাদের কাছে দেশের ৬,০০০ পারমাণবিক অস্ত্রের হেফাজত রয়েছেযা ১৯৫০-এর দশকে কেজিবির কাছে ন্যস্ত ছিল এবং তারা এখন পুতিন কর্তৃক পুনঃজাতীয়করণ করা কৌশলগত তেল শিল্পও পরিচালনা করে ।"

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিপ স্টেট তত্ত্ব

চর্যাপদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেখক ভুসুকুপা বলেছিলেন-‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী ‘-অর্থাৎ হরিণের মাংস সুস্বাদু বলেই শিকারী তার পেছনে তীর হাতে ছোটে। হরিণের সৌন্দর্যই তার জীবনের কাল। মার্কিন ডিপ স্টেটের তত্ত্বতালাশের বেলাতেও এই উক্তি বেশ খাটে। কোন দেশ বা রাষ্ট্র যখন নানান দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে তখনই তাকে নিয়ে শুরু হয় ডিপ স্টেট এর নজরদারি। ঠিক হরিণের মতো সুযোগ বুঝে তীরবিদ্ধ করতে তৎপর হয় গভীর রাষ্ট্র। খোদ আমেরিকাতেও এ তত্ত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে একটি গভীর রাষ্ট্র তার বিরোধিতা করছে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সমর্থকরা পরামর্শ দিয়েছিলেন যে কিছু নামহীন নির্বাহী শাখার কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তা গোপনে তার জন্য অপ্রীতিকর হয় এমন কিছু তথ্য ফাঁস করে তার নীতি এবং আইন প্রণয়ন কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করতে একটি গভীর রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যানন এবং ব্রেইটবার্ট নিউজের মতো অতি-রক্ষণশীল সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে যে, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ওবামা ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে একটি গভীর রাষ্ট্রীয় আক্রমণ পরিচালনা করছেন। এই অভিযোগটি স্পষ্টতই ট্রাম্পের অপ্রমাণিত দাবি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যে ওবামা ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার টেলিফোনের আড়ি পাতার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসনকে বিপথগামী করার জন্য গোপনে কাজ করা একটি ডিপ স্টেটের অস্তিত্বের প্রশ্নে বর্তমান এবং প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দ্বিধাগ্রস্ত রয়েছেন।

৫ জুন, ২০১৭ সালে দ্য হিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে , অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ সিআইএ ফিল্ড অপারেশন এজেন্ট জিন কোয়েল বলেছেন, ট্রাম্প-বিরোধী গভীর রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করা সরকারি কর্মকর্তাদের একটি দলের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও, তিনি বিশ্বাস করেন যে, সংবাদ সংস্থাগুলি দ্বারা প্রকাশিত তথ্য ফাঁসের সংখ্যা সম্পর্কে ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ ন্যায্য।

"যদি আপনি কোনও প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে এতটাই হতবাক হন, তাহলে আপনার পদত্যাগ করা উচিত, একটি সংবাদ সম্মেলন করা উচিত এবং প্রকাশ্যে আপনার আপত্তি জানানো উচিত," কোয়েল এমনটাও বলেন। "যদি আরও বেশি সংখ্যক মানুষ মনে করে, 'আমি এই প্রেসিডেন্টের নীতি পছন্দ করি না, তাই তাকে খারাপ দেখানোর জন্য আমি তথ্য ফাঁস করব- তাহলে আপনি একটি নির্বাহী শাখা পরিচালনা করতে পারবেন না।"

অন্যান্য গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট প্রশাসনের সমালোচনামূলক তথ্য ফাঁসকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে তুরস্ক বা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো গভীর রাষ্ট্রগুলির সাংগঠনিক সমন্বয় এবং গভীরতার অভাব রয়েছে।

২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ান সরকারের সম্ভাব্য জড়িত থাকার সাথে সম্পর্কিত একটি অতি-গোপন নথি নাম প্রকাশ না করে সংবাদ সংস্থার কাছে ফাঁস করে গুপ্তচরবৃত্তি আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিল জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থায় (এনএসএ) কর্মরত একজন তৃতীয় পক্ষের ঠিকাদার। সেটি অবশ্য ২০১৭ সালের ৩ জুন। হলফনামা অনুসারে- ২০১৭ সালের ১০ জুন এফবিআই যখন জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, তখন ২৫ বছর বয়সী রিয়েলিটি লেই উইনার, স্বীকার করেছিলেন যে, জানার প্রয়োজন' না থাকা সত্ত্বেও এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি গোপন করা হয়েছে তা জানা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে তিনি গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি সনাক্ত এবং মুদ্রণ করেছিলেন।"

বিচার বিভাগের মতে, উইনার আরও স্বীকার করেছেন যে তিনি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তিনি জানতেন যে প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি এবং একটি বিদেশী জাতির সুবিধার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। উইনারের গ্রেপ্তারের ঘটনাটি ট্রাম্প প্রশাসনকে অসম্মান করার জন্য একজন বর্তমান সরকারি কর্মচারীর প্রচেষ্টার প্রথম নিশ্চিত ঘটনা। ফলস্বরূপ, অনেক রক্ষণশীল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যে তথাকথিত "গভীর রাষ্ট্র" সম্পর্কে তাদের যুক্তিগুলিকে শক্তিশালী করার জন্য এই মামলাটি ব্যবহার করতে দ্রুত এগিয়ে এসেছেন। যদিও এটা সত্য যে উইনার তার সহকর্মীদের কাছে এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ্যে ট্রাম্প-বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেছিলেনতার কর্মকাণ্ড কোনওভাবেই ট্রাম্প প্রশাসনকে অসম্মান করার জন্য একটি সংগঠিত গভীর রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করে না

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ ঘটনার বেশ ক’বছর আগে ২০১৪ সালে প্রাক্তন কংগ্রেসনাল সহকারি মাইক লফগ্রেন " অ্যানাটমি অফ দ্য ডিপ স্টেট " শীর্ষক প্রবন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যে একটি ভিন্ন ধরণের ডিপ স্টেট কর্মকাণ্ডের অস্তিত্বের অভিযোগ করেছিলেন ।

কেবলমাত্র সরকারি সত্তার সমন্বয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠীর পরিবর্তে, লফগ্রেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটকে "সরকারের উপাদান এবং শীর্ষস্তরের অর্থ ও শিল্পের অংশগুলির একটি সংকর সমিতি বলে অভিহিত করেছেন-যা আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত শাসিতদের সম্মতির উল্লেখ ছাড়াই কার্যকরভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে সক্ষম।"

লফগ্রেন লিখেছেন, ডিপ স্টেট কোন গোপন, ষড়যন্ত্রমূলক চক্র নয়একটি রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র বেশিরভাগই স্পষ্ট দৃষ্টিতে লুকিয়ে থাকে এবং এর পরিচালকরা মূলত দিনের আলোতে কাজ করে। এটি একটি শক্ত-সংযুক্ত গোষ্ঠী নয় এবং এর কোনও স্পষ্ট লক্ষ্য নেই। বরং, এটি একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, যা সরকার এবং বেসরকারি খাতে বিস্তৃত।"

কিছু দিক থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গভীর রাষ্ট্রের লফগ্রেনের বর্ণনা রাষ্ট্রপতি ডোয়াইট আইজেনহাওয়ারের ১৯৬১ সালের বিদায়ী ভাষণের কিছু অংশের প্রতিধ্বনি করে। যেখানে তিনি ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপতিদের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের দ্বারা অযাচিত প্রভাব, চাওয়া বা অপ্রত্যাশিত, অর্জনের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে সতর্ক করেছিলেন।

বাংলাদেশ কী মার্কিন ডিপ স্টেটের জাঁতাকলে?

গ্রামে যারা বড় হয়েছেন তাদের কেউ কেউ সাপে ব্যাঙ ধরা দেখেছেন। শুনেছেন বিষে নীল হওয়া ব্যাঙের কাতরোক্তি। ব্যাঙের মৃত্যুপূর্ব করুণ সুর এখনো আমাদের কানে বাজে। সুতরাং জুলাই আন্দোলন, শেখ হাসিনার নির্মম পতন এবং তার পরে ঘটে যাওয়া বহুমাত্রিক ঘটনায় মার্কিন ডিপ স্টেট কেনো কিভাবে কতোটুকু সম্পৃক্ত তা দেশ বিদেশের বহুল আলোচনার অন্যতম আধেয়। শুধু এদেশের মানুষই নন, অন্যান্য দেশের রাজনীতিকবোদ্ধাগণও পুরো ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।

এটি যেমন স্পর্শকাতর তেমনি এশিয়ার নৃপতিদের কাছে জটিল এক সমীকরণ। সুতরাং বাংলাদেশের সরকার পলায়ন ও পতনে মার্কিন ডিপ স্টেট প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত বলে চাউর রয়েছে। কারণ নেপথ্যের ঘটনায় উঠে এসেছে ডিপ স্টেটের বহু ঘটনার ঘনঘটা। এমন দাবি যারা করেন তাদের যুক্তি- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ইত্যাদি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। ২০২৩ সালের ভিসা নীতির (Visa Policy) মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে জানায়, তারা স্বাধীন সুষ্ঠ নির্বাচন চায়। এটা শেখ হাসিনা সরকারের ওপর একধরনের আন্তর্জাতিক চাপও বটে। এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কর্মকাণ্ড আরও রয়েছে। যেমন-র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তাদের Sanctions. মানবাধিকার বা গণতন্ত্র ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরী হয়েছিল। এগুলোতে অনেকেই ডিপ স্টেট-এর স্ট্র্যাটেজিক প্যাটার্ন দেখেন। তাছাড়া ওয়াশিংটনভিত্তিক কিছু থিংক ট্যাঙ্ক লবিস্ট ফার্ম শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নানা প্রবন্ধ বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। মার্কিন প্রশাসনের নীতি চাপও ছিল যারপরনাই। বিশেষ করে প্রবাসী গোষ্ঠীর সংগঠিত প্রচারনা ছিল উদাহরণ দেয়ার মতো।

কেউ বলেছেন, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলে বা পশ্চিমা কৌশল থেকে বিচ্যুত হলে, ডিপ স্টেট বা মার্কিন নিরাপত্তা পরিকাঠামোয় উদ্বেগের কারণ হবে। সেজন্যই হয়তো মার্কিন প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ কিছু শক্তি (সম্ভবত ডিপ স্টেট-এর অন্তর্ভুক্ত) বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করতে চেয়েছিল বেশ আগে থেকেই। তাই Soft Coup এবং Color Revolution এর পথ বেছে নিয়েছিল ডিপ স্টেট। সেই নিরীখে বিশেষ কিছু এনজিও, নির্দিষ্ট সংখ্যক থিংক ট্যাঙ্ক ও  মিডিয়া কাজ করেছিল ডিপ স্টেটের কলাকুশলীদের সঙ্গে। অভিজ্ঞ রাষ্ট্রদূত বা আন্তর্জাতিক সংগঠনে দায়িত্বপালনকারী ব্যক্তি যাঁরা পরে শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্ত য়েছেন এমন বিশিষ্টদের সন্নিষ্ট করেছিল ডিপ স্টেট। কূটনীতিবিষয়ক অধ্যাপক যাঁরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ভূ-রাজনীতি বৈদেশিক নীতি বিষয়ে গবেষণা শিক্ষাদান করেন তাঁদেরকেও সঙ্গে নিয়েছে। রাজনৈতিক উপদেষ্টা বা নীতি-প্রণেতাদেরও  নজরে নিয়েছিল গভীর রাষ্ট্র বা ডিপ স্টেট।

এটি ঠিক যে, মার্কিন ডিপ স্টেট সরাসরি কোন সেনা পাঠায় না, বরং বহুবর্ণিল কৌশল ও কর্মপন্থা ব্যবহার করে। যেমন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিরোধিতা অভিযোগে সহায়তা করেছে। এবং সেটিকে যৌক্তিক জায়গায় নিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সমীকরণে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেছিলেন শেখ হাসিনা। ডিপ স্টেট দেশ বিদেশে দলটির একতরফা ভুল, গোয়ার্তুমি ও দলীয়করণকে প্রবাসীদের কাছে আগুনের শিখার মতো পৌঁছে দিয়েছে। খোদ দলীয় লোকজনও সরকারের বিরোধিতা করে মাঠে নেমেছে। রেজিম চেঞ্জ-এর আন্দোলনে  ছাত্রসমাজের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে নাগরিক সমাজ।  বিএনপি জামায়াত ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক জোটগুলো সরকার পতনের দাবিতে নতুন আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলঅনেকে জুলাই আন্দোলন বলে এক আখ্যা দিয়েছে। এই আন্দোলনের নেপথ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী, প্রবাসী লবি এবং আন্তর্জাতিক চাপের সম্ভাবনার প্রসঙ্গ এসেছে। সর্বোপরি মার্কিন ডিপ স্টেটের মাধ্যমে সরকার পতনের ইতিহাস শুধু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নয়এটি বাস্তব ইতিহাসের অংশ। বর্তমান যুগে এটি অনেক বেশি পরোক্ষ কৌশলগত (covert and strategic) হয়ে উঠেছে। সুতরাং ডিপ স্টেট যে ফরম্যাটেই কাজ করুক না কেনো এটি মূলত: বহুবৃত্তিয় নেক্সাস। এটি সাম্রাজ্যবাদের আধুনিক স্ট্রাকচারও বটে। ডিপ স্টেট কোন রাষ্ট্রের দিকে নজর দিলে গবাক্ষপথ তৈরী করে হলেও সেখানে যেকোনভাবে প্রবেশ করবে। তাদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রে কোন অভ্যন্তরীণ গোলযোগে না হলেও ‘মার্কিন গভীর রাষ্ট্র ’ তা ঘোরতরভাবে তৈরী করবে এবং ভূক্তভোগী রাষ্ট্রের নাগরিকদের অবস্থা হবে গোল্ড ফিস-এর মতো।

সর্বোপরি এও সত্য যে, মার্কিন ডিপ স্টেট একটি বাস্তব রাজনৈতিক ধারণা হলেও বাংলাদেশে সরাসরি হস্তক্ষেপের কোনো খোলাখুলি প্রমাণ নেই। তবে পরোক্ষ চাপ কৌশলগত অবস্থান থেকে তারা শেখ হাসিনা সরকারকে কোণঠাসা করতে চেয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। ব্যাপারটি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও। স্বাভাবিকভাবেই তিনি তা অস্বীকার করেছেন। তবে তার উত্তর জন্ম দিয়েছে নানারৈখিক রহস্য ও প্রশ্নের।