এক রেনেশাঁয় জেগে উঠি
- ড. অখিল পোদ্দার
আকাশ ভরা সূর্য-তারা ছিল—একসময়। এখনো আছে। দেখা যায় না খালিচোখে। বয়ে চলা বিপন্ন সময়ে মানুষ হয়ে উঠেছে আধারের বস্তু। যেখানে শাস্ত্রকালও আধেয়রূপে এলিয়নের ছবি আাঁকে। আমরা সেইযুগে ফোরাম বানাচ্ছি। সাকিন যাদের কুষ্টিয়ায়।
অন্য সমিতিগুলো ষান্মাসিক কর্মে ব্যাপৃত। বছরে দু’বার উত্থিত। শীতে জেগে উঠে পিকনিক করে। আরেকবার যোগেজাগে ইফতার অনুষ্ঠান। এই-তো। তাদের বহুমানববিশিষ্ট কমিটি আছে। কিন্তু অনবদ্য কোনো কাজ নেই, উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মের কথাও শোনা যায় না। আমরা মডেল হতে চাই। ট্রেনের মতো। সবার পরে এসে আগে ছেড়ে যাওয়া। ডালভাঙা কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাঁড়িয়ে আমরা তাই দেখতাম। খোকসা রেল স্টেশনের বৃক্ষটি এখন আর নেই। এমনকি কাঠগোলাপের গাছটিও নেই কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনে। এ দুটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আগে আসা ট্রেন পরে ছেড়ে যাওয়া দেখতাম। অন্যরা বহুআগেই উপজেলা সমিতি করেছে। মুজিববর্ষে এসে আমরা কুষ্টিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ যুক্ত হলাম বৈচিত্রময় কার্যক্রমে। এজন্য স্যালুট সবাইকে। স্বাধীনতার সূর্যোদয় হয়েছিল এ মাটিতে। অথচ অনেককিছুতেই আমরা পিছিয়ে।
জগতি পর্যন্ত রেলের উপর প্রথম ট্রেন এসেছিল এই মাটি ছুঁয়ে। উপমহাদেশের দ্বিতীয় গার্লস স্কুল কুমারখালীতে। মোহিনী মিল-যা এ বাংলার বস্ত্রশিল্পের হিরোশিমা নাগাসাকি । কলকব্জার ধ্বংশাবশেষ-তোমাকে লাল সালাম। পারলে জেগে ওঠো কোন একদিন। নিশ্চয় আমাদের ফোরাম বলবে, কুমারখালীতে বস্ত্রপল্লী কেন নয়! সংস্কৃতির জেলাই যদি হয় তাহলে কুষ্টিয়াকে কেন ঘোষণা করা হবে না ‘কালচারাল হাব’ হিসেবে? আমরা কি সাংস্কৃতিক মিউজিয়াম বানাতে পারবো। এখন অব্দি কোথাও নেই।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় হয় নি। যাঁদের গা করবার কথা ছিল তাঁরা শরীর দোলান নি। এর বদলে দুর্গম চরে পিলার গারা হয়েছে রবীন্দ্র ভার্সিটির। নিশ্চয় এতে প্রণব মুখার্জির সায় ছিলো না। এখনো নেই। তাহলে রবীন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি কি পূর্ণ হতো পারে? যা পদ্মার ওপারে কোথাও নেই। পূর্ববাংলার কৃষিঅর্থনীতি পাল্টে দিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরতো চেষ্টা কষ্ট দুটোই করেছেন। আজকের গ্রামিণ ব্যাংক, ধান ব্যাংক, কৃষক সমিতি, চাষী ক্লাব যাই বলি না কেন সার্বজনীনভাবেই রবি ঠাকুর ছিলেন উন্নয়ন প্রত্যাশি।
গড়াইতে চর। দীর্ঘদিন ধরে। রবীন্দ্রনাথের বজরার লগি ঠেলতে গিয়ে একআধটু বালু উঠেছিল সেই কবে। সেসময় আকাশ ভরা সূর্য তারা ছিল। মেঘভর্তি গনগনে রোদ্দুর উঠতো। তাই অগ্নিস্নানে সূচি হতো ধরা। অতপর একবিংশ শতাব্দির গোড়াতে নেদারল্যান্ডের কৌশলীরা এসেছিলেন বালু কাটতে। লাভ হয় নি। আমাদের ফোরামের বারী ভাই এ ঘটনার অপার সাক্ষী। আর গড়াই খননের উদ্বোধনী খুব যত্নের সঙ্গে কাভার করেছিলেন ফোরামের সভাপতি শ্রদ্ধাভাজন রেজোয়ানুল হক রাজা দাদা। সম্ভবত ৯৭ কিংবা ৯৮ তে। এ কারণে যদুবয়রা খালের দিকে তাকানো যায় না। গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প জ্বরাগ্রস্ত। মাহমুদ হাফিজ ভাই খুব ভালো বলতে পারবেন ক্যানেলের দুর্দশা সম্পর্কে।
মিরপুর, ভেড়ামারা, দৌলতপুরের সঙ্গে সুবাদ যৎসামান্য। শুনেছি সেখানে উপর্যুপরি তামাক চাষ হচ্ছে। জ্বাল দিয়ে প্রসেস হয় কাঁচা পাতা। কড়া ঘ্রাণে আক্রান্ত হচ্ছেন গর্ভবতী। শিশুরা হচ্ছে বর্ণিল প্রতিবন্ধী। নিশ্চয় আমাদের ফোরাম সোচ্চার হবে তামাকের বিরুদ্ধে।
কুষ্টিয়া হঠাৎ গজানো শহর নয়। অতিপুরণো। ইতিহাসের গন্ধযুক্ত এবং মানবিক। সেই শহরে নতুন কোন রাস্তাঘাট নেই। পিচের উপর পিচ—শুধু প্রলেপ পড়েছে। মহকুমা যুগ থেকে আজ অব্দি সেই খুপড়ি রাস্তা সরু গলি, এপাড়া সেপাড়া। এরমধ্যেই শিল্পবিপ্লব ঘটিয়েছে বিআরবি। আমাদের সাত রাজার ধন। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন সাইকেল দাবড়ে কারখানায় যায় শিশিরভেজা সকালে। দৃশ্যটি শ্রদ্ধাবনত। কিন্তু এমন ‘টেক অব স্টেজ’-এ তারা পোষাকশিল্প ব্যতিরেকে হাসপাতাল বানাচ্ছে! শ্রমবান্ধব না হলেও হয়তো সেটি জনবান্ধব হবে। মালিক ভালো বোঝেন, উনার স্বাধীনতা সবার আগে।
আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মের আগে ১৮৬৯ সালে কুষ্টিয়া পৌরসভার হ্যাপি বার্থ ডে। জন্ম হয়নি শরৎচন্দ্রের কিংবা টেলিফোন আবিষ্কারক আলেক্সজান্ডার গ্রাহামবেল নয়তো তুর্কি বীর কামাল আতাতুর্কের। স্বরাজ আন্দোলন, ইংরেজবিরোধী ভারত ছাড়ো, চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ১৯৩২ সালের লবন আইন ভঙ্গ, রাজশাহীতে খাপড়া বিদ্রোহ, মজমপুরে ফকির বিদ্রোহ, প্যারী সুন্দরীর নীল বিদ্রোহ, বাঘা যতীনের আত্মত্যাগ ইতিহাসে স্মরণীয়। এমনকি ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, ৬৯ এর গণআন্দোলনে এই জেলার মানুষের ভূমিকা এখনো অনন্য। মহান একাত্তরের অমর ইতিহাস আমাদের কুষ্টিয়া। চুন সুড়কির ভাঁজে-খাঁজে আরো কতো স্মৃতি ঢাকা পড়লেও ম্লাম হয়নি এখনো। কলের গান থেকে কলির গান বিশেষ করে দেহতত্ত্ব—তারও উদ্ভাসন কুষ্টিয়ার সাধকদের পরতে পরতে। লালন, রবি, নজরুল থেকে শুরু আজকের শিল্পী, অভিনেতা, খেলোয়াড়দের কে নেই তালিকায়! মধ্যযুগের ব্যালাড কিংবা ট্রাজিকমেডির প্রভাব এখনো কুষ্টিয়ার শিল্পীদের সুরে-ছন্দে। এই মাটির গুরু পরম্পরার সিদ্ধি অন্যদের কাছে অনুকরণীয়।
এদিক থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাঝে অতি ক্ষুদ্র এক বিন্দুকণা এই পৃথিবী। তার মাঝে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাংলাদেশ। সেখান থেকে বহুধাবিভক্ত হয়ে কুষ্টিয়া। সেদিক থেকে হয়তো এ ফোরামের প্রয়োজন বৃহত্তর পরিসরে কিছুটা ম্লান কিন্তু সার্বজনীনভাবে এটি মাইক্রো ইকোনমি গ্রোথের জন্য দরকারি। '
এ খেলা বিশ্বসাহিত্যের আসরে নিজের মননকে তুলে ধরার প্রতিবিন্যাস। তাতে নিমগ্ন কাল বাঁধা পরে ভালোবাসার সাতপাকে। ক্রমশ: । উপলব্ধির ব্যাস ব্যাসার্ধ যখন নিয়তি ও বাস্তবিকতার পরম্পরায়, তখন বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো উপস্থিত তিরিশের কবিগোষ্ঠী। যাঁদের অন্যতম বুদ্ধদেব বসু।
নিজের মধ্যে, নিজের সঙ্গে, নিজের মতো করে যুদ্ধের শুরু; তারই আঙ্গিকে টুকরো টুকরো স্বগতোক্তি মঞ্চস্থ হয়ে নাটকে উঠে এসেছে। দৈবক্রমে নয়, নিরাসক্ত কালস্রোতের প্রবহমানতাও নয়। বরং প্রাচীনের সঙ্গে বর্তমানের নিয়তি এসে কষ্ট ও বোধের সরুগলিতে মিলে গেছে। যে কারণে বুদ্ধদেব বসুর সংলাপ শুধু নাটকের স্থিতিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, মানবপ্রজাতির বিপন্ন মননের মধ্যে খেলা করেছে অন্তর্গত রক্তের মতোই। তাতে নীলকণ্ঠ পাখির হঠাৎ খসে পড়া পালকের স্পর্শ যেমন প্রতীয়মান তেমনি বেলা-অবেলায় সারাবেলা তৎকালের ভ্রমর গুঞ্জরিত সচল প্রাণের কাঙ্ক্ষায়;
আশা-নিরাশায় দুলতে থাকা জীবন, প্রেম-অপ্রেমের মধ্য দিয়ে চলা ফল্গুধারাকে তিনি প্রধান্য দিয়েছেন। প্রতীক্ষার প্রহরে জন্ম নেয়া মানবেতিহাসের আদিসত্য রূপান্তর করেছেন হৃদয়াভ্যন্তরে অন্ধকার মুক্তির ভেতর দিয়ে। আপনাআপনিই কিংবা আকাঙ্ক্ষিত এই বিশেষ উপলব্ধির জন্য আমরাও অপেক্ষা করি কোন না কোন প্রবহমানতার বাঁকে। সমসাময়িক সেই মঞ্চের কিনারে দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব বসু মানবাত্মার বিচ্ছিন্নতাবোধ ও চরম পরিণতি আধুনিক মননে অনুভূতিগম্য করে তুলেছেন। তাঁর তাবৎ নাটকে প্রতীয়মান হয়েছে আলোঅন্ধকারের মানুষ। তাতে আছে রঙিন ও রঙ্গিলার পারস্পরিক সমাধান। শাস্ত্রকানা থেকে বিশেষায়িত হয়ে ওঠার প্রেমউন্মাদনা। বুদ্ধদেব তাই আমার কাছে শুধু ধারণাগত পাঠ্যই নয়, বরং ধারণযোগ্য এবং গ্রহণীয়। একক থেকে বহুর দিকে গমনাগমনের আদর্শলিপি।
( বিশিষ্ট সাংবাদিক ড. অখিল পোদ্দার, একুশে টেলিভিশনের বিদায়ী চিফ নিউজ এডিটর। ইতোপূর্বে তিনি একুশে টিভির চিফ রিপোর্টার, হেড অফ ইনপুট ও বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন। দৈনিক জনকন্ঠ ও ভোরের কাগজ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ছিলেন )
