রোববার,

০৮ জুন ২০২৫

|

জ্যৈষ্ঠ ২৪ ১৪৩২

XFilesBd

ব্রেকিং

২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থ-উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। মোট বাজেট -৭,৯০,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা-৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি -২,২৬,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬%) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা-৫

জাস্টিস রাধাবিনোদ পাল: সম্মান-শ্রদ্ধার অনন্য অহঙ্কার

গৌতম কুমার রায়

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ৭ জুন ২০২৫

জাস্টিস রাধাবিনোদ পাল: সম্মান-শ্রদ্ধার অনন্য অহঙ্কার

১৯৪৭ সাল সময়বর্তী ভারত বর্ষের নদীয়া জেলা, তৎপরবর্তী সময়ের কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার তারাগুনিয়ার পদ্মার নিকটবর্তী মৃতপ্রায় হিসনা নদীর তীর ঘেঁসা স্বনামধন্য গ্রাম সালিমপুর। যেখানে ১৮৮৬ সালের ৭ জানুয়ারী মহাকালের ইতিহাস রচনার জন্য বাবা বিপিনবিহারী পাল আর মাতা মগ্নোময়ী দেবীর কোলে আশ্রিত হয়েছেন কর্মবহুল বৈচিত্র্যময় এক বর্নাঢ্য মনিষীর। তিনি বাঙ্গালীর অহংঙ্কার, বিস্ময়কর মানব জাস্টিস্ ড. রাধাবিনোদ পাল। বাবা আর মা’র ঘরে কোন উপায়ন্ত ছিলনা। যেখান থেকে সংসারে দু’মুঠো অন্নের সংস্থান হয়। রাধাবিনোদ যখন তিন বছর বয়সে সবেমাত্র পৃথিবীর উপর আশ্রয় নির্ভর করতে শুরু করেছেন, তখনই বাবা বিপিনবিহারী সন্ন্যাসব্রত নিয়ে সংসার ত্যাগী হন। মা মগোন্নময়ি দেবী তাঁর দুই মেয়ে আর একমাত্র ছেলে রাধাকে নিয়ে অনিশ্চিত জীবনের পথে যাত্রা শুরু করেন। বাবার ভালবাসাকে স্পর্শ করেনি রাধা। রাধা বড় হতে থাকেন মায়ের দীর্ঘশ্বাস ভরা আত্মবিশ্রিত বুকের ব্যাথা চাপা ভাবগাম্ভির্যে, অনাহুত আদর আর ঠাকুর দাদা ফ্যালান চন্দ্র পালের আশির্বাদ ও স্নেহের উষ্ণ ছায়াতে। দেশ ও সমাজের আর কয়েকটি সন্তানেরমত আগামির অনিশ্চিত ভবিতব্য আশাকে বুকে ধরে আট বছর বয়সে তারাগুনিয়ার ঈমান আলী পন্ডিতের পাঠশালায় পাঠ জীবনের হাতে খড়ি নেন রাধা।

এখানে পাঠ জীবন শুরু করার পেছনেও রয়েছে বর্ণনাময় এবং স্মৃতিময় এক আশ্চর্য ঘটনা। সংসারের অভাব আর দারিদ্রতাকে মোকাবেলা করতে গিয়ে মমতাময়ী মা অন্যের কাজে শ্রমখেটে যখন দিনাতিপাত করছেন, তখন সেই জোয়ারে পাল তুলতে গরু চড়ানোর কাজে সময় ব্যয় করতেন আমাদের রাধা। বাড়ীর পাশে পাঠশালা থাকায় প্রতিদিন বিদ্যালয়ের সাথে ঘনারণ্যে গরুগুলো ছেড়ে দিয়ে রাধা স্কুল ঘরের খোলা জানালা দিয়ে মনোনিবিষ্ট করে ক্লাশের পাঠ্যক্রম শ্রবণ করতেন। একদিন শহর থেকে স্কুল পরিদর্শক এলেন পাঠশালার লেখাপড়ার হাল হকিকত দেখতে। ক্লাশে এসে ছাত্রদের কাছে পাঠ্যক্রমের বিষয় সম্পর্কে জানতে একে একে প্রশ্ন করতে লাগলেন ছাত্রদেরকে। কিšতœু ছাত্ররা উত্তর দিতে অপারগ হয়ে নিশ্চুপ ছিল। আমাদের রাধাবিনোদ পাল সে অবস্থা বেশী সময় সহ্য করতে না পেরে স্কুল পরিদর্শককে বললেন, ‘ স্যার আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর জানি।” বিষ্ময়কর বালকের সাহস দেখে চমকে গেলেন পরিদর্শক। বললেন তোমার নাম কি ? তুমি কি কর ? রাধা বললেন স্যার আমরা খুবই গরীব তাই পড়ার সময় ও সাধ্য নেই। পরিদর্শক সাহেব বালকের অনর্গল প্রশ্নের উত্তর শুনে আরো আশ্চর্য হলেন। তিনি শিক্ষক ইমান আলীর কাছে ছেলেটার খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তাদের দারিদ্রতার কথা, সংসারের কথা। তিনি স্কুল থেকে বিদায় নেবার সময় ইমান আলী পন্ডিতকে বলে গেলেন ছেলেটার লেখা পড়ার ব্যবস্থা নেবার জন্যে । আর এই রাধার পড়াশোনার ব্যয়ভার তিনি নিজেই বহন করবেন বলে প্রতিশ্র“তি দিয়ে তাকে স্কুলে ভর্ত্তির ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন। ড. পালের লেখাপড়া এবং জীবন গড়ার ভিত্তিটা এখান থেকেই শুরু। ঠাকুরদাদা ফ্যালান চন্দ্রের অবর্তমানে সেখানে তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু রাধার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর শিক্ষার প্রতি অসীম আগ্রহে তাঁর মেসোমহাশয় বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার মোড়ভাঙ্গা গ্রামের কেদারনাথ পালের বাড়িতে আশ্রয় ও বলতে গেলে প্রশ্রয়ও জোটে এই পরিবারের। আমাদের গর্বিত রাধাবিনোদ পালের বয়স তখন সবে মাত্র এগার বছর। আত্মপ্রত্যয়ী রাধা তাঁর মেসোমহাশয়ের দোকানে মাসিক চার টাকা বেতনে ফাই-ফরমাস খাটে আর তাঁর গর্বিত স্বর্ণগর্ভা মাতা ঐ বাড়ীতে রান্নাবান্নার দিকটা দেখভাল করতেন। মায়ের পাশে রান্না ঘরের টিমটিমে মাটির পিদিমের আলোয় বসে একান্ত নিজের মতো করেই পরিকল্পনাহীন অনানুষ্ঠানিক পড়াশোনা করতেন বিষ্ময়কর মেধাবি রাধা। দোকানের নিয়মিত এক শিক্ষিত সজ্জ্বন খরিদ্দার অপরিচিত নতুন এই রাধাকে দোকান বন্ধের পর রাতে দেখে, মেসো কেদারনাথের কাছে এই বালকের বিষয়ে খোঁজ খবর নেন। তাঁর সৌম্য,শান্ত তীক্ষè অথচ দূরদৃষ্টির মাঝ দিয়ে লুক্কায়িত প্রতিভাকে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, সে কথার সূত্র ধরেই বিভিন্ন কথার ফাঁকে রাধাকে স্কুলে পাঠানোর প্রস্তাব করেন। মেসো কেদারনাথ তাঁর অসুবিধে সত্ত্বেও রাধাকে বাঁশবাড়ী এম.ই স্কুলে ভর্তি করে দেন। স্কুলের যাবতীয় খরচের বিনিময়ে রাধাকে মেসোমহাশয়ের সকল ফরমায়েস পালন করতে হতো।

শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রতি তাঁর এই আকর্ষণ রাধাকে তাঁর আগত লক্ষ্য থেকে সরে যেতে দেয়নি। দিনমানে সময় না পাওয়ায় রাতের তারাকে স্বাক্ষী করে ঝিঁঝিঁ পিদিমের আলোয় তিনি রচনা করতে থাকেন তাঁর অভাবনীয় সাফল্যের ভবিষ্যৎ সৃষ্টির বুনিয়াদ। ভোর থেকে দোকানের কাজ সেরে স্কুলে যেতে তাঁর প্রায়ই বিলম্ব হতো। শিক্ষকগণ তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এ কারণে, যে কোন পরীক্ষায় রাধা সকলের থেকে উত্তম মেধার পরিচয় দিয়ে খুব চমৎকার রেজাল্ট ছিনিয়ে নিতেন। বরাবরই অসামান্য কৃতিত্ব ও প্রজ্ঞাবান রাধা নজরে আসেন কুমারী গ্রামের শিক্ষা বান্ধব জমিদার শৈলেন চন্দ্র পালের।তিনি রাধার সমস্ত দায়িত্ব নিজে নিয়ে তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেন কুমারী এম.ই স্কুলে। সেখানে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন শহরের কুষ্টিয়া হাই স্কুলে। থাকার যোগাড় হয় কমলাপুর-জিয়ারখির জমিদার রামচন্দ্র রায় চৌধুরীর বাড়ি। মেধার এমন বিচ্ছুরণের আভা উদ্ভাসিত হওয়ার জন্যই, স্রোতে ভাসা কচুরি পানার মতো ভাসতে থাকা রাধাকে রাজশাহীর দুবাহাটির জমিদারের আশ্রয়ে চলে যেতে হয়। দুবাহাটির ‘রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯০৩ সালে এন্ট্রান্স (ম্যট্রিকুলেশন) পাস করেন। এরপর রাজশাহী কলেজ (বর্তমানে রাজশাহী ওল্ড ডিগ্রী কলেজ) থেকে আবারো বৃত্তি নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি প্রথম থেকেই বৃত্তির পুরো টাকা পাঠিয়ে দিতেন তাঁর অভাবি মায়ের কাছে। আর শহরের দীনবন্ধু পালের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন। সেখান থেকে দীনবন্ধু পালের বদলি জনিত কারণে রাধা নতুন আশ্রয় নেন ‘হেমন্ত কুমারী’ বোডিং-এ। এই বোডিং এর মাসিক খরচ ৬ টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন কলেজের ইংলিশ অধ্যাপক রাখাল চন্দ্র ঘোষ। আর কলেজের খরচ কলেজ কর্তৃপক্ষ দিতেন। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার সময় টাকা নেই রাধার কাছে, পরীক্ষার ফিস্’র অভাবে দুশ্চিন্তায় পড়েন রাধাবিনোদ পাল। সৃষ্টিকর্তা এবার এ দায় লাঘবের ভার বাত্লে দিলেন দীনবন্ধু পালের বাড়ীতে থাকার সময় পরিচিত বন্ধু তেজেন্দ্র সিংহ রায়কে দিয়ে। তিনি ১৯০৮ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে গণিত (সম্মান) বিষয়ে প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। তিনি ১৯১২-১৯২০ সাল সময় পর্যন্ত ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণীতে এলএল,এম পাশ করেন। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভূক্ত হন। ১৯২৪ সালে তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডক্টর অব লজ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৩৫ সাল। রাধাবিনোদ পাল বিশেষ পরিচিত গোত্রীয়, আত্মীয় বদ্যিনাথ পালের আমন্ত্রণে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কাঁকিলাদহ গ্রামে এসে এই জায়গা দেখে মুগ্ধ হন। এরপর তাঁকে অনুরোধ করাতে তিনি এখানে বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরীর সিদ্ধান্ত নেন। রাধাবিনোদ পাল যৎ-সামান্য জমি ক্রয়ের পর আমলা এস্টেটের জমিদার জনৈক সাহা বাবু তাঁকে বেশ কিছু জমি প্রদান করেন। সব মিলে তখন তাঁর প্রায় ৫০ একর জমি। আকর্ষণীয় বাড়ি বানিয়ে তিনি তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চারিদিকে দেশি-বিদেশি ফলবান বৃক্ষের চারা লাগিয়ে গড়ে তোলেন নয়নশোভিত কানন। তিনি সকলের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য তৈরী করেন একটি বিশাল আকৃতির দীঘি। যা আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে টলটল করে চেয়ে আছে গভীর এক জিজ্ঞাসার দৃষ্টি নিয়ে। তাঁর জীবনটা ছন্দপতনের দোলাচলে তৈরী এক নাটকীয় ঘটনার ঘনঘটা। ১৯৪১ সাল। তাঁর জীবন এসে যুক্ত হয় বিশ্বব্রহ্মান্ডের নাড়ীর সাথে। জানুয়ারির ২৭ তারিখে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হয়ে পরবর্তী বছরের ১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে অধিষ্টিত হয়ে বহাল থাকেন ১৯৪৩ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত। পরবর্তী সময়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। বহাল থাকেন ১৯৪৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রেশ তখনও চলছে। কথিত শত্র“ ও মিত্র উভয় পক্ষ এগিয়ে গেছে যুদ্ধে। সময়টা তখন যুদ্ধ শেষের দিকে। মরণাস্ত্রের এমন বিভীষিকাময় মৃত্যুর হোলিখেলায় উম্মাত্ত আগ্রাসন সভ্যতার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দেয়াকে তিনি কখনই স্বাভাবিকভাবে অন্তরে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর অন্তরাত্মার করুণ কাকুতির পবিত্র আর্তনাদ সৃষ্টিকর্তার ঐশী পরশ স্পর্শ করল। ১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হলো। মিত্র শক্তিধর দেশ হিসেবে দাবিদার আমেরিকা বিচার করার সিদ্ধান্ত নেয় জাপানিদের যুদ্ধপরাধের জন্য। কোন আন্তর্জাতিক আইন বা সভ্যতাকে শ্রদ্ধা না করে শুধুমাত্র বৃটেন এবং নেদারল্যান্ডকে সাথে নিয়ে আমেরিকা গঠন করে ‘ টোকিও দূরপ্রাচ্য মিলিটারি ট্টাইব্যুনাল’। ট্টাইব্যুনালে ১১ দেশ হতে নিয়োগ দেয়া হয় বিচারপতিদের। গঠন করা হয় একটি বিচারক প্যানেল। বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত দেশ হিসেবে জাপানের মাটিতেই জাপানের সমরবীদ জেনারেল ‘হিদেকী তোজোর’ বিচার করা হয় টোকিও ট্রাইব্যুনালে। যুদ্ধজয়ী মার্কিন বাহিনীর আগ্রহে এই বিচারিক আদালতে সমন্ত বিশ্ব থেকে হেভিওয়েট এই বিচারপতি নির্বাচন করা হয়। এমনকি বিভিন্ন দেশের স্বনামধন্য বিচারকদের মধ্য হতে বেছে নেয়া হয় প্রজ্ঞাবান বিচারকদেরকে। ঐ প্যানেলে বৃটিশ-ভারতের সদস্য বিচারক হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন আমাদের ড. রাধা বিনোদ পাল। আন্তর্জাতিক বিচারক প্যানেলের একজন সদস্য হিসেবে রাধা বিনোদ পাল এই উপমহাদেশ এবং বাঙালি জাতির জন্য বয়ে আনলেন এক দুর্লভ সম্মান। ১৯৪৬ হতে ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ড.পাল বিচারের সার্বিক ঘটনার বিষয় নিড়িখ ও পূঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করেন। আনুষ্ঠানিক বিচারকার্য শুরু হওয়ার আগে বিচারকগণের নিয়মিত শপথবাক্যের অতিরিক্ত বাক্য সংযোজন করে শপথের ব্যাবস্থা নেয়া হলো যে, ‘‘এই বিচারকার্যের কোন তথ্যাদি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে না’’। রাধাবিনোদ পাল বিচারকার্যের উপর এমন ঘৃণ্য সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেন। বিচারের এক পর্যায়ে অন্য চার জন বিচারপতি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করে জাপানের সমরবীদ জেনারেল হিদেকী তোজোকে অভিযুক্ত করে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দেন। এই আদালতের চারজন বিচারক রায় দেন বস্তুত নিয়োগ দাতাদেরকে তুষ্ট করে। কিন্তু রাধা বিনোদ পালের রায় সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি তাঁর দীর্ঘ ১২৩৫ পৃষ্ঠার পূঙ্খানুপূঙ্খ রায়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বর্ণনা করেন যে, এই রায় আমেরিকার পক্ষে সাজানো এবং তা প্রহসনেরও। ‘‘মিত্র পক্ষ যদি শত্র“ পক্ষের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মোকাবিলা করার জন্যই যুদ্ধে শামিল হয়েছিল বলে দাবি করে, তবে শত্র“ পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ১৯৪৫ সালের ৬ আগষ্ট হিরোশিমায়, ৯ আগষ্ট নাগাসাকিতে ১২ হাজার কিলো টন ওজনের মতো উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা সম্পন্ন আণবিক বোমার বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে প্রায় ৩ লাখ নিরীহ মানুষ এবং শিশু-নারীকে হত্যা করে আরেকটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজ করেছে মিত্র শক্তি। তিনি এ জন্য আমেরিকা ও তার মিত্রদেরই বিচার দাবী করেন। তিনি ভর ও গতির আবিস্কারক, বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনষ্টাইন ও আণবিক বোমার আবিস্কারক ওপেন হাইমারদেরমত বিজ্ঞানীদেরকে সতর্ক করে উল্লেখ করেন তাঁদের উদ্ভাবিত বোমা বিশ্বে শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে হুমকির কারণ। যেখানে কয়েক ঘন্টায় লক্ষ লক্ষ সাধারণ নিরাপরাধ মানুষের জীবন নাশ হয়েছে এবং এদের মধ্যে বৃদ্ধ, মহিলা ও শিশু রয়েছে’’। এই ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে বিচারের একতরফা গুরুদন্ড থেকে একটি অমানবিক বিচারকে রক্ষা করেন। জাপানের উপর নিষেধাজ্ঞা আসে, ৫০ বছরের মধ্যে কোন পারমাণবিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। সে নিষেধাজ্ঞার কল্যাণে পরবর্তীতে বিশ্ব অবাক দৃষ্টি মেলে চেয়ে দেখলো, নতুন বিশ্বের জন্য জাপানের নিরবিচ্ছিন্ন পথ হেঁটে চলার পিচ্ছিল দৃশ্য। ১৯০০ সালের শেষ দিকে জাপান এবং ভারত তথা বাঙালির সাথে সূত্রিত হয় অভিন্ন নাড়ির সম্পর্ক। এ সম্পর্কের যুক্ততা সৃষ্টি করেন রাধা বিনোদ পাল। অর্থাৎ বাংলাদেশের তথা কুষ্টিয়ার ড. রাধা বিনোদ পাল। সুষ্ঠ বিচারকার্য পরিচালনার জন্য জাপানীদের কাছে এই রাধা বিনোদ পাল বসে আছেন দ্বিতীয় দেবতার আসনে। ১৯৫২ সাল। কয়েকজন জাপানি এবং বাঙালি ড. পালের নেতৃত্বে টোকিওতে শুরু হয়েছিল এক আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলন। ঐ আন্দোলনে ড. পাল তার জ্বালাময়ি অথচ সম্প্রীতি ও সাম্যের বক্তৃতায় আবারো কঠোর যুদ্ধবাজ আমেরিকার ও তার মিত্রদের বিচার দাবি করেন। ঐবছর তিনি জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং খ্যাত প্রতিষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছিলেন। এসময়ে নিহোন বিশ্ববিদ্যালয় হতে ড. রাধা বিনোদ পালকে সম্মান সূচক ডিলিট ডিগ্রী প্রদান করা হয়েছিল। ১৯৬৬ সাল। তিনি জাপান সফরের সময়ে দেশটির সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে জাপানের সর্বোচ্চ সম্মানীয় প্রদক ‘কোক্কা কুনশোও’ অর্থাৎ ‘ পার্পল রিবন’ গ্রহণ করেছিলেন। জাপানের রাজধানী টোকিও এর অন্যতম বৃহৎ এভিনিউর নামকরণ করা হয়েছে এই কিংবদন্তিতুল্য মহামনিষীর নামে। বিচারকের গাউন পরিহিত স্মৃতিস্তম্ভের বুক জুড়ে এই বিচারকের আবক্ষ্যচিত্র জাপানে গর্বিত এক প্রতীক হিসেবে শোভা পাচ্ছে। জাপানের কিয়োটা শহরে তাঁর নামে রয়েছে যাদুঘর, রাস্তার নামকরণ ও স্ট্যাচু। জাপানিদের কাছে দেবতুল্য এই রাধাবিনোদ পালের ডকুমেন্টারী চলচিত্র তৈরীর অন্বেষায় কাঁকিলাদহে তাঁর বাড়ীতে এসে এখনও তাঁর অস্তিত্ব’র স্পন্দন খুঁজে ফেরে জাপানীরা। রাধাবিনোদ পাল পরবর্তী তাঁর প্রজন্ম এখন বসবাস করেন ১৬ নম্বর, ডোভার লেন, কলকাতায়। বাংলার গর্ব, কুষ্টিয়ার এই অহংঙ্কারের রূপ-রসের গবেষণায় বেরিয়ে আসে ড. রাধাবিনোদ পালের জন্ম, মৃত্যু, বেড়ে ওঠাসহ আদি বাসস্থান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট। ১৯৫২-১৯৬২ সাল। ড. রাধা বিনোদ পাল জাতিসঙ্ঘে আন্তর্জাতিক আইন সভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৭ সাল। ড. পাল ভারতের জাতিয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত হয়েছিলেন। ১৯৬০ সাল তিনি ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতিয় সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ পেয়েছেন। এই সময়ে রাধা বিনোদ পাল টোকিওর ‘ইয়াসুনি জিনজা’ নামক বিতর্কিত ও জাতিয় শিক্ষা এবং ধর্মীয় মন্দির, কিয়োতো শহরে শোওয়ানোমোরি পাহাড়ি উদ্যানে দুটো পাথরের স্মৃতি ফলক স্থাপন করেনছিলেন। এটা জাপানিদের কাছে এতই সম্মানের যে এই সম্মান জাপানিরা আর কোন বিদেশিকে দেয় নাই। খ্যাতিমান এই মনিষী ড. রাধা বিনোদ পাল ১৯৬৭ সালের ১০ জানুয়ারী দেহত্যাগ করেন কলকাতার ১৬ নম্বর, ডোভার লেন’র নিজ বাড়ীতে। যার মাধ্যমে একটা ইতিহাস, সাহস ও গর্বিত অহংঙ্কারের যবনিকা টানা হলেও তাঁর রেখে যাওয়া দৃঢ় কর্ম ও মননশীলতা জাপানিদের মনে যেমন অনুপ্রেরণা যোগায়, তিনি আমাদের কাছে তেমনি বোধ ও সম্পদ সৃষ্টির উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছেন অন্যন্য শ্রদ্ধার অন্তর আত্মায়। তার লিখিত ও পঠিত ১২৩৫ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক রায় বাংলা, জাপানি,ইংরেজীসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদৃত হয়েছে। বর্তমানে ঐ রায় কেম্ব্রিজ, অক্সপোর্ড ও হাভার্ডসহ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ও আইন প্রতিষ্ঠানে পাঠ করা হচ্ছে। যে ঘটনা শ্রদ্ধা ও মানবতার কথা বলে : ১৯৪১ সালের কথা। বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার এক অজ পাড়াগাঁয়ের নাম সালিমপুর। সেই স্কুলের এক শিক্ষক ঈমান আলী পন্ডিত। যার বদান্যতা এবং আদর্শের অনুকরণে গড়ে ওঠা ছাত্রের নাম জাস্টিস্ ড. রাধা বিনোদ পাল। তিনি বিশাল ভারত বর্ষের বিচার বিধাতা, প্রধান বিচারপতি। যার নাম-ডাক এখন ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশময়। যার অক্ষর গুরু, জ্ঞান দাতা এবং পথ প্রদর্শক পন্ডিত ঈমান আলী। গর্বে শিক্ষকের যেমন বুক ভরে আসে, তেমনি পন্ডিত জী’র আদর্শ মাখা অবয়বটাকে চোখে ও মনে আলিঙ্গনে শ্রদ্ধার পরশ স্পর্শ করে ধন্য মনে হতো বিচার বিধাতা রাধা বিনোদ পালের। প্রধান বিচারপতি নিযুক্তি হওয়ার পরে যখন রাধার পরিচ্ছন্ন বিচারে চারিদিকে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে, তখন পন্ডিত জী’র মায়া মনের কোনে ক্রমে ক্রমে জমতে শুরু করলো এক অনুভূতি। প্রাণের রাধাকে এক নজর দেখতে তাঁর বড়ই ইচ্ছে জাগ্রত হতে থাকে।। পন্ডিত জী সুযোগ পেলেই মানুষকে ডেকে বলতেন জানো আমাদের রাধা আজ অনেক বড় হয়েছে। দেখবে ও (রাধা ) আরো বড় হবে। একদিন আমার রাধা বিশ্বকূলে আমাদের (বাঙালীর) মুখ উজ্জ্বল করবেই। হঠাৎ এক দিন মনের অজান্তে পন্ডিত ঈমান আলী বাড়ী থেকে বেড়িয়ে পড়লেন। খুঁজতে খুঁজতে কলকাতা, তারপরে হাই কোর্টে গিয়ে হাজির। তিনি জানেন এখানে তাঁর রাধা আছে। রাধা কোথায় বসেন ? সামনে লোক পেলেই পথ আগলে জিজ্ঞাসা করেন পন্ডিত জী। লোকটা পাগল নাকি ? কেও কেও আঁড় চক্ষু দৃষ্টে মন্তব্য করে কোথায় যেন হারিয়ে যায় অনেক মানুষের মাঝে। আবার লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করেন পন্ডিত জী। এক সময়ে সন্ধান মেলে রাধার। ঈমান আলীর রাধা বিশাল বিচারালয়ে উঁচু চেয়ারে বসে আদালত পরিচালনা করে চলেছেন। তাঁর চেয়ারের পেছনে পাঙ্খা দুলিয়ে বাতাস বিলিয়ে চলেছেন পাঙ্খা বাহকেরা। কালো কোট পরিহিত অনেক নামি দামি উকিল-মোক্তারেরা এজলাসের সন্মুখে ‘মে লড’ বলে রাধাকে বয়ান দিচ্ছেন। নির্বিঘœ চিত্তে রাধা সে বয়ান শ্রবণ করে চলেছেন। আদালত কামরার প্রতিটা দরজায় হাফ প্যান্ট পরা রক্ষীরা নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছেন। আমি রাধার কাছে যাবো। পন্ডিত জী’র এই আকুতি রক্ষীদের মনে রেখাপাত ঘটাতে পারে নাই। তারা পন্ডিত কে দরজার বাইরে ঠেলে বের করে দিল। আবারো পন্ডিত জী রক্ষীদেরকে আকুতি-কাকুতি জানিয়ে বললেন আমি রাধার কাছে যাব্,ো এবারে সজোরে ধাক্কা দিয়ে পন্ডিত কে দরজার আরো বাইরে পাঠিয়ে দেয় রক্ষীরা। নাছোর বান্দা ঈমান আলী চিৎকার করে বলে চললেন আমি আমার রাধার কাছে যাবো। রক্ষীরা তাকে এবারে সজোরে ধাক্কা দিয়ে এজলাসের বাইরে পাঠিয়ে দিতে গেলে পন্ডিত জী মাটিতে লুটিয়ে পরেন। এখন কিন্তু বিচারপতি রাধার কর্ণগোচর হলো ততক্ষনে ঈমান আলী মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছেন। ‘যেন আমার পন্ডিত জী ঈমান আলীর মতো মনে হচ্ছে।’ আরে তাইতো ! বিচক্ষণ বিচারক রাধা বিনোদ আদালত মূলতবী করে নেমে এলেন এজলাস থেকে। ঈমান আলীর কাছে গিয়ে লুটিয়ে পড়া পন্ডিতজীকে তুলে দাঁড় করালেন। ততক্ষনে পুরো আদালতের উকিল, মোক্তার, কর্মকর্তা, কর্মচারীগণ প্রধান বিচারপতির পিছু নিয়েছেন। সবাই কৌতুহলে তাকিয়ে দেখছেন। একি হতে যাচ্ছে। কি করতে যাচ্ছেন তাদের প্রধান বিচারপতি। কে এই আগন্তক? ঈমান আলী পন্ডিত কে সামনে দাঁড় করিয়ে হাঁটু গেড়ে নিজের মাথা বসুমতির উপরে ঠেকিয়ে দিয়ে ঈমান আলীর পদ তাঁর নিজ ভালে স্পর্শ করে প্রণাম ও প্রণতি জানালেন আমাদের বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল। এর পরে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন আমার শিক্ষক ও পন্ডিত জী ঈমান আলী।। যিনি আমাকে এই আসনে বসতে ভীত সৃষ্টি করে দিয়েছেন। একে একে অনেকে তখন পন্ডিত জী কে প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাতে লাগলেন। রাধা বিনোদ পাল তাঁর শিক্ষাগুরু কে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন তাঁর আপনালয়ের উদ্দেশ্যে।

আবেগাপ্লূত গুরু- শিষ্য কেউই তখন তাদের চোখের জল বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারেন নাই। শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের এমন ভক্তি ও শ্রদ্ধার নিদর্শন আজ একেবারেই হারিয়ে গেছে। ঘটনায় বুক ভরা গর্ব এবং অহংঙ্কার যেন শিক্ষকে মনে করিয়ে দিয়েছিল বিধাতা তাঁর জন্ম সার্থক করে দিল।। শিক্ষক কে কাছে পেয়ে বিচারপতি ফিরে গেলেন দৌলতপুরের ছালিমপুর গ্রামের সেই ছেলেবেলায় যেখানে ধেনু চড়াতে চড়াতে স্কুলের জানালার ফাঁক দিয়ে পড়ার প্রতি রাধার মনকে খুবই বিচলিত করে তুলতো। পন্ডিত ঈমান আলীর অবিশ্রান্ত পাঠ দান কৌশল। সূত্র: দৌলতপুরের মাটির রূপগন্ধে, মানুষের হৃদয়ের প্রচলিত মনের কথা থেকে।

লেখক: গৌতম ‍কুমার রায় গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশবিজ্ঞানী।