
সাংবাদিক ড. অখিল কুমার পোদ্দারের ৮ টি কবিতা
ধারাবাহিক কবিতা-অধুনা চর্যাপদ
( চর্যাপদ-৩১ )
ঢোলকলমির বনে
রতনের হাতে খুন হওয়া কুকুরটি তেড়ে এসেছিল মৃত্যুর পর
যেমন করে আসে না মানুষ, ঘোরে শুধু ছায়া
তেমনি, মৃত্যুর পর –
ফিরে এসেছিল নেড়ি কুত্তাও ;
রতন মালাকার স্কুল পলাতক এক দুর্ধর্ষ
শৈশবের বহু ক্ষণ চুরি করে নিজের মতো করেছিল রঙিন
সিদ্ধ মেটে আলু, আধপাকা কাঁঠাল কিংবা মুঠভর্তি ভাজা কলাই
বহু রাত গেছে তার ঈদগাতলায়
বটের প্রশস্ত ডালে রাতঘুমে সাক্ষী শুধু মাঠের শেয়াল
আদুরে রত্নাকর হলেন হোটেল বয় যখন সংসারে বাতাস বেহাল
একদিন বাজার ঘোরা বেওয়ারিশ মুখ দেয় সন্দেশ ডালায়
অপরাধে আহা হত্যা হয় বুভুক্ষ কুকুর
তিন মাস পর-
চন্দ্রালোকিত রাতে স্টেশনের প্ল্যাটফরম ছেড়ে যায় রতন
ঢোলকলমির আড়ালে বদনা পানে চেয়েছিল তার মুখ
ঝকমক ট্রেনের আলোয় তেড়ে আসে বেওয়ারিশ
বিস্ময় কিশোর সামলাতে চায় মৃত আত্মাকে
একে একে জুটে যায় আরও তিন পাঁচ
চারধারে ঘেউ ঘেউ বিকট সে ধ্বনি
সাহসী রতন চেনে না রতনকে
বিদ্যুত আলো তখন ছায়া হয়ে আসে
ট্রেন যাবে শিলিগুড়ি ছোটে বাতাসে
সেই থেকে-
পুর্ণিমা রাত কিংবা ঢোলকলমির বন
কুকুরের ছায়ার মতো আষ্ঠে ধরে
ক্রমশ: পাংশু হয় কিশোরের দাপট
এ এক আজব রে দস্যু রত্নাকর
জলভর্তি গ্লাস দেখে কুকুরের মুখ
খুন না করেও হত্যাকারী জেনো
স্মৃতিরা সাক্ষ্য দেয় জঞ্জালের মতো
আত্মা শরীর ছুঁ’লে ছোটে না সহজে
নিজের অপরাধে সাক্ষী যখন নিজে
আজিমপুর হতে বনানী অব্দি অসংখ্যা প্রচ্ছায়া
সুযোগ পেলে মৃতরা মানুষ হয়
কথা বলে কথার সাথে, যদি বাক্য দেয় ;
[ সি সাইড, পোর্টল্যান্ড, অরেগন যুক্তরাষ্ট্র ২৪ মার্চ ২০২৩ ]
( চর্যাপদ-৩২ )
টুপটাপ ফুলের মধ্যে
বীজ বড় একাকী
নিভৃতে নি:শেষ-
ম্লান খেত, স্নিগ্ধ আকাশ
এবং
চলমান শরীর ক্রমশ মিলে যায়
পাতাদের সংসারে বুনো ঘাসের মতো ।
একটা ধুসর ছায়াবৃক্ষ
ত্রিকোণমিতি কম্পাস যেমন
মেঘের স্মৃতি ধরে রাখে আকাশকে
রঙ বড় একাকী
তুলির আঁচর না হলে কে আঁকবে বলো
ম্লান খেত, খরা দেহ আর নিঃসঙ্গতা ।
[ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কলাবাগান, ঢাকা- ১৯ নভেম্বর ২০২৪ ]
( চর্যাপদ-৩৩ )
আপনাকে কল্পনা করে
শেষ হতে
লাগে ভাল মাননীয়
বেশ !!
একাকী হয়নি নি:শেষ
স্নেহ সরোবর, ছায়াবৃক্ষের ভুত কিংবা
নীল তরবারি হেঁকে ছুটে চলা কল্পতরু
সবার সব কিছু ছিল-
অথচ আপনাকে মডেল মেনে
সজ্জনকান্দার দুর্বাঘাস, সাঁই ফকিরের মাটি
আর -
ডাহুক পাখির কান্নায় জেগে ওঠা গোরস্থান
শেষ অবধি ভাল লাগে আপনাকে ভেবে ভুলে
নিয়তি এমন হয়, একরোখা তমাল গাছ
নুইয়ে পড়া মাটিতে
শেষ হতে লাগে ভাল
একাকী সবিশেষ;
[ কেটি, হিউস্টন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র-২৬ মার্চ ২০২৩]
( চর্যাপদ-৩৪ )
পায়ের স্বাস্থ খারাপ থাকায়
হাঁটতে পারোনি আমার বুকে
শুধু শুয়েছেন নির্জ্ঞাণ ভোলামহাজন
অদৃশ্য খড়গ যার রক্ত বরাবর
এঁকেছে কখনো শানিত উপপাদ্য
এসো জবা, শিউলি কিংবা উষ্ণতম পারফিউম
বলি দেবার আগ অব্দি যেভাবে দেবীদল
রক্তের আলকাতরা মেখে নেয় উরুর শরীরে।
[ এনার্জি করিডোর, হিউস্টন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র ২৭ মার্চ ২০২৩ ]
( চর্যাপদ-৩৫ )
আকাশি জলে, নীল মেঘ পেতেছে সংসার
পড়ন্ত বিকেল তার বিস্তৃত মাঠ
চেনা বট, অচেনা দোকানি
ঝুরিভাজার গ্রাম কথা বলে নিজের ভাষায়
বাঁশের মাচায় খেলা সাপলুডুর হিসেব
যে জানে সেই শুধু জ্ঞানে
ব্যাস্ট্রিক মন পাল্টে দিয়েছে নিরাক অর্থনীতি;
ভাঙা রাস্তায় উপচে পড়া নছিমন
বিষাক্ত ভটভটি আঁকড়ে ধরেছে
ভালবাসার বদলে অসম সুবিধা
সুদূর পিয়াসী মানুষেরা
ভুল প্রেমে ভুলে যায় সহসা শরীর
এ প্রান্তে মার্কিনকন্ঠ ওপ্রান্তে বেলগ্রেড-
অথচ-
ক্লান্ত মেঘেরা এখনো ঘরে ফেরে সন্ধ্যায়
আটলান্টিকের রেখা চিনে ;
[ কেটি, হিউস্টন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র-২৬ মার্চ ২০২৩]
( চর্যাপদ-৩৬ )
জলের আবছায়ায় পুলকিত নদীর কোল
হারানো অতীত এসো স্বপ্ন হই
গোধুলির আলো উতরে
কষ্টের ভেলা ভেসে ।
মাটি পুরস্কৃত হবার আগেই
উদলা লাঙল ধুলো ছড়িয়ে দেয়
নির্জলা বাতাসে
স্বচ্ছ হবার সুযোগ নেই এ পৃথিবীর
যতক্ষণ পর্যন্ত গাঙচিল
ছায়া ধরে রাখে দূষণ নদীজলে
ডানার স্বাধীনতা কিংবা আকাশের মেঘ হয়ে নামা
দূরবর্তী সীমানা শুধু কৌপনিধ্বজার;
[ টাকসিম স্কয়ার, ইস্তাম্বুল, তুরস্ক ১৪ এপ্রিল ২০২৩]
( চর্যাপদ-৩৭ )
আকাশ ভরা সূর্যকান্ত বাতাস ভরা প্রাণ
তারই নিচে হারায় মানুষ হারায় যে যৌবন
আকাশ তোমার ভালবাসা আকাশবাড়ি খোলা
প্রশ্বাসে প্রাণ জাগায় স্নেহ চিন্তা রঙিন মেলা॥
ক্লান্ত সময় জগতজুডে প্রাণের আলো কৈ
ঐ যে দামাল নষ্টনীড়ে অযথা হৈ চৈ।
কোথায় তোমার গন্তব্য মন পবন জোডে হাওয়া
এই যে বড় ধাক্কা তোমার জোরশে জোড়ে গাওয়া ।।
মন তুমি কী রঙিন হবা সন্ধ্যে দ্বীপের আলো
জ্বালাও নিশি পোড়াও যতো নিশিন্দার ছাই কালো
আকাশ আছে মাথার পরে আকাশ খাবে দুপুর
দিনের বেলা জোছনা ঘিরে সন্ধ্যে বাজায় নূপুর ।।
অন্তহীনা কাজের ভিঁড়ে অনন্ত এই মানুষ
বড্ড ব্যাকুল শ্রাবণ দুপুর চৈত্রে ওড়ায় ফানুস
মানুষ বুঝি মানুষ হবে শহরজুড়ে রব
চারটি মানুষ খাটিয়া বয় একটি মানুষ শব ।।
গল্পে নামে গপ্পসপ্প ডামাডোলে ঢোল
খেুঁদি কুত্তার জ্যাকেট গায়ে কে বলবে তুই খোল
ক্লান্ত সময় জগতজুডে প্রাণের আলো কৈ
ঐ যে দামাল নষ্টনীড়ে অযথা হৈ চৈ।।
[ইস্তাম্বুল, তুরস্ক ১৬ এপ্রিল ২০২৩]
( চর্যাপদ-৩৮ )
অন্তহীনার কাজের ভিঁড়ে
শহরগুলোয় সন্ধ্যে নামে
যজ্ঞজটের ডামাডোলে, বেঞ্চে বসা মানুষ যতো
অকারণে হেঁসে ওঠে, কারণগুলো গপ্পসপ্প ।
বেশ শহরের বেকার মানুষ
হাজার দোষে দুষ্ট তাই
গলির পাশে বিড়ির ধুয়ো,
হেয়ার ড্রেসার গল্প শোনো
মিথ্যাগুলো সত্য সত্য,
আয়না হাসে ছায়ার মতো
সত্যি
বেঞ্চে বসা মানুষ যতো ।
শহর ঢাকার গপ্পসপ্প
সবাই ধনী সবাই বড়
আমাক তুমি চিনো মিয়া?
সন্ধ্যে হলে কামে নামে
ভোজবাজিতে ক্লাবপাড়া
অরুণদ্যুতির গজলগানে
শেরাটনে জলসারত
সত্যি
বেঞ্চে বসা মানুষ যতো ।
সন্ধ্যেগুলো অলস অবশ
শান্তিনগর সানারপাড়ে
তালি-চামড়ার ব্যাগগুলো সব
কোথায় যাবে হাজারিবাগে?
পয়সা ছাড়া রক্তজবা
পয়সা দিলে পয়সা মেলে
গলির শেষে কাকের বাসা
ছোকছোকানি কোকিল ঘোরে
বেকার যুবক বেকার বুডো
এই যে দ্যাখো শহর ঢাকা
সবার নাকি পকেট ফাঁকা
সবাই গরিব শতেক ধনী
শিল্পীত মুখ পটে আঁকা ।
মুখখানি তার মৌমাছিগণ
কাঁঠালরসে শান্তি জ্বলে
ঐ না শোনো বেইলি রোডে
পুড়ছে হোটেল কড়াই তেলে ।
অশান্তিতে জ্বলছে সবাই
কেউ ছাড়ে না বস্তিভবন
সবাই মেকি যন্ত্রমন্ত্র
ফুলের মধু মোমাছিগণ ।
আঁধার রাতে কহর পড়ে
নহর বাজে নন্দিপাড়ায়
জোনাক জ্বলা বাতির নগর
আতিক তাপস মশা খ্যাদায় ।।
[ পুকুরপাড়, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কলাবাগান, ঢাকা- ৭ জুন ২০২২)