
জেন জি বা “Generation Z” (সংক্ষেপে Gen Z) হলো একটি সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক প্রজন্মগত শ্রেণিবিন্যাস। অন্য নাম জুমার (Zoomer) বা অভয় প্রজন্ম। সাধারণত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া তারুণ্যকে বোঝায়। বাংলাদেশে এই প্রজন্মের প্রতিনিধিরা এখন তরুণ ভোটার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, নতুন চাকরিপ্রার্থী কিংবা উদ্যোক্তা। এরা ইন্টারনেট-নেটিভ, সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় এবং বৈশ্বিক বিষয়ে অধিক সচেতন। 'প্রজন্ম জেড’দের অন্য নাম জুমার (Zoomer) বা অভয় প্রজন্ম হচ্ছে সাহস্রাব্দিকদের পরবর্তী এবং জেনারেশন আলফার পূর্ববর্তী একটি জনসংখ্যাগত শ্রেণি। Gen Z-এর আগে আসে মিলেনিয়াল প্রজন্ম (যারা প্রায় ১৯৮১-১৯৯৬ সালের মধ্যে জন্ম নিয়েছে), আর এর পরে আসে Generation Alpha (২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী জন্ম নেওয়া প্রজন্ম)।
মূলত জেন-জি এমন একটি শব্দবন্ধ, যার সঙ্গে আগে আমাদের কোন পরিচয় ছিল না। কেবল নাইন্টিজ কিড বা নব্বইয়ের শিশু-কিশোর বলে একটি পরিচয়ের গণ্ডিতে একটি প্রজন্মকে পৃথক করা যেত। বর্তমানে এই প্রজন্মের সদস্যদের বয়স ১২ থেকে ২৭ বছর। এই প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য, ভালো দিক, মন্দ দিক নিয়ে অনেক কথা হয়, অনেক গবেষণা ও আলাপও হয়। এদের কমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-
১. ডিজিটাল নেটিভ (Digital Native): এরা জন্ম থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদির মাঝে বড় হয়েছে। প্রযুক্তি এদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। এদের নিয়ে বড়দের অনেক ধরণের অভিযোগ থাকলেও তারা ঠিকই তাদের জায়গায় অটুট।
২. সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর: ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক—এসব মাধ্যমে এদের জীবনের বড় সময় কাটে। তথ্য গ্রহণ ও প্রকাশ—দুটিই এরা এ মাধ্যমেই বেশি করে।
৩. সংবেদনশীল ও সচেতন: সামাজিক বিচার, জলবায়ু পরিবর্তন, লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবাদ ইত্যাদি বিষয়ে এরা সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চায়।
৪. ব্যক্তিস্বাধীনতা ও পরিচয়বোধে গুরুত্ব: এরা নিজের পছন্দ-অপছন্দ, যৌন পরিচয়, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ে স্বাধীনতা চায়।
সঙ্গত কারণেই তাই প্রশ্ন ওঠে, জেড যেহেতু ইংরেজি বর্ণমালার সর্বশেষ বর্ণ, তাহলে জেনারেশন ওয়াই বা এক্স নিশ্চয়ই আছে। তাহলে তারা কারা?
সাধারণত ২০ থেকে ২৫ বছর অর্থাৎ দুই যুগের মতো সময় ধরে একটি প্রজন্ম গড়ে ওঠে। যদিও তাদের শুরু ও শেষের বছরটি বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নির্ধারিত হয়। প্রযুক্তিগত ক্রমবিবর্তন, বিশ্বায়ন ও সভ্যতার উন্নয়নও এ ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটু জেনে নেওয়া যাক বিভিন্ন প্রজন্মের নাম, তাঁদের জন্মের সময়সীমা ও বর্তমানে তাঁদের বয়সের মান।
গ্রেটেস্ট জেনারেশন বা মহত্তম প্রজন্ম: এঁদের জন্মকাল আনুমানিক ১৯০১ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত এবং এঁদের বর্তমান বয়স অবশ্যই ৯৫ বছরের বেশি।
সাইলেন্ট জেনারেশন বা নীরব প্রজন্ম: এঁদের জন্মকাল আনুমানিক ১৯২৮ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এবং এঁদের বর্তমান বয়স ৭৯ থেকে ৯৪ বছর।
বেবি বুমার্স জেনারেশন: এঁদের জন্মকাল আনুমানিক ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এবং এঁদের বর্তমান বয়স ৬০ থেকে ৭৮ বছর।
জেনারেশন এক্স: এঁদের জন্মকাল আনুমানিক ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এবং এঁদের বর্তমান বয়স ৪৪ থেকে ৫৯ বছর।
জেনারেশন ওয়াই বা মিলেনিয়ালস বা সহস্রাব্দ প্রজন্ম: এঁদের জন্মকাল আনুমানিক ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। এবং এঁদের বর্তমান বয়স ২৮ থেকে ৪৩ বছর। এই প্রজন্মেরই যাঁদের জন্ম আবার ১৯৯০ সালের ভেতরে অর্থাৎ যাঁরা পুরো নব্বই দশকে তাঁদের শৈশব-কৈশোর পার করেছেন, তাঁদের বলা হয় নাইন্টিজ কিডস। এঁদের মা-বাবারা বেশির ভাগই বুমার্স ও জেনারেশন এক্সের সদস্য।
জেনারেশন জেড বা জেন-জি: এঁদের জন্মকাল ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এবং এঁদের বর্তমান বয়স ১২ থেকে ২৭ বছর। এঁদের মা-বাবারা মূলত জেনারেশন এক্স ও ওয়াইয়ের সদস্য।
জেনারেশন আলফা: এদের জন্মকাল আনুমানিক ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এবং এদের বর্তমান বয়স ০ থেকে ১২ বছর। এদের মা-বাবারা আবার জেনারেশন ওয়াই বা সহস্রাব্দ প্রজন্মের সদস্য।
যদিও আলফা প্রজন্মের শেষ সময় এখনো নির্ধারিত হয়নি। এই প্রজন্ম এখনো শিশু এবং এদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য ও পরিসংখ্যান এখনো সর্বব্যাপী প্রকাশিত নয়। কাজেই বলা যাচ্ছে না যে এই সময়কাল শেষ হবে কত সালে। জেনারেশন জেডের সবচেয়ে বয়সী সদস্যও মাত্র ২৭ বছরের। অর্থাৎ এই প্রজন্মের সদস্যদের দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে বেশ কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে ইতিহাস বলে এঁদের হাত ধরে আসে নতুন পৃথিবী। জেন জি প্রজন্মের জীবযাপন, আচার-আচরণের ধরন যেমন অন্য জেনারেশন থেকে একটু আলাদা, তেমনই কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে তাদের ব্যবহৃত ভাষাতেও। দৈনন্দিন কথোপকথন, লেখা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করে থাকেন, যা পুরোনো প্রজন্মের অনেকেই বুঝতে পারেন না। তাদের কাছে পুরো ব্যাপারটিই অসহিষ্ণু। কেউ কেউ বলেন এদের আদব-কায়দার অভাব ও শিক্ষার কমতি আছে। হয়তো কথা বলতে গিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে বলে ফেললো-অরা (Aura). শব্দটি জেন-জি’র ছেলেমেয়রা সাধারণত ব্যক্তিত্বের পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করে। একজন কতটা “কুল”বা ইতিবাচক; কিংবা কতটা “আনকুল” বা নেতিবাচক, তা প্রকাশ এই শব্দ দিয়ে। এক্ষেত্রে তারা ইতিবাচক অর্থে “অরা গেইন” এবং নেতিবাচক অর্থে “অরা লস” শব্দ ব্যবহার করে। অতএব এমন শব্দের সঙ্গে তো পুরোনোরা একেবারেই অপরিচিত। ইংরেজি সাসপেক্ট এবং “সাসপিশিয়াস” শব্দ দুটির সংক্ষিপ্ত রূপ সাস (Sus)। কোনো বিষয়ে বা কারও ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করা হয় সাস (Sus) শব্দ দিয়ে। নির্দিষ্ট কারও কিংবা কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা কিংবা পরচর্চা করা বোঝাতে টি (Tea) শব্দের ব্যবহার করা হয় । মূলত চা খেতে খেতে আলোচনা থেকে “টি” শব্দের ব্যবহার শুরু। বাসিন (Bussin) শব্দটি মূলত কোনো কিছুকে খুব ভালো বোঝাতে বলা হয়। রান্নার প্রশংসা করতেও ব্যবহার হয় শব্দটি। কেউ মিথ্যা বলছে, তা ধরতে পারলে “ক্যাপ/ক্যাপিং” বলা হয়। সত্য বোঝাতে ব্যবহার করা হয় “নো ক্যাপ” শব্দযুগল। কোনো ফলাফলের লক্ষ্যে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দেওয়া, যাতে অন্য পক্ষ বিব্রত বা অস্বস্তিবোধ করে। এমন বোঝাতে কুক (Cook) শব্দটি ব্যবহার হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিচিত বাক্য হলো “লেট হিম কুক”। অর্থাৎ সে এমন পরিস্থিতি তৈরি করুক, যাতে পরে বিব্রত বোধ করে। ইংরেজি “ডিলিউশনাল” শব্দটির বিবর্তিত রূপ “ডেলুলু (Delulu)”। অসম্ভব বা আকাশকুসুম মনোভাব বোঝাতে শব্দটির ব্যবহার হয়। বিশেষত কোনো সম্পর্কের বেলায় কারও আকাশকুসুম প্রত্যাশাকে ডেলুলু বলা হয়। সোজা বাংলায় বলতে গেলে, ভাব দেখানো বোঝাতে এই শব্দের ব্যবহার। এই ভাব হতে পারে যেকোনো বিষয়ে। হতে পারে নিজের অর্জন, গুণ কিংবা প্রভাবপ্রতিপত্তি নিয়ে। অর্থাৎ নিজের কর্মকাণ্ডের উৎকৃষ্টতার প্রকাশকে ফ্লেক্স বলা হয়। বিশেষ উন্নতি অর্থে এই শব্দের ব্যবহার। ড্রিপ (Drip) শব্দটি ট্রেন্ডি এবং উচ্চশ্রেণির ফ্যাশন বোঝাতে ব্যবহার করে। কুল শব্দের বিকল্প হিসেবেও ড্রিপ তারা বলে থাকে। কোনো ব্যক্তির বর্তমান আগ্রহ বা অগ্রাধিকার বোঝাতে ব্যবহৃত হয় এরা (Era) শব্দটি।সাধারণদ “কে কীভাবে দেখল, তা তোয়াক্কা না করে নিজের অবস্থানে অবিচল থাকা” বোঝাতে বেইজড (Based) শব্দের ব্যবহার করে জেন জি। তবে শব্দটি এখন ব্যবহৃত হয় কোনো মতামত বা কোনো কিছুতে একমত পোষণ করার ক্ষেত্রে। কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো কিছুর প্রতি শক, হতাশা কিংবা বিব্রতবোধ বোঝাতে ব্রাহ্ (Bruh) শব্দটির ব্যবহার হয়। এটি মূলত ইংরেজি “ব্রাদার” শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। কারও বড় কোনো উন্নতি দেখলে সেটিকে ইঙ্গিত করে “গ্লো আপ” ব্যবহৃত হয়। মূলত “গ্রেটেস্ট অব অল টাইম” (Greatest of all Time)–এর সংক্ষিপ্ত রূপ গোট (GOAT).বাংলায় যাকে বলা হয় “সর্বকালের সেরা”। অতিরঞ্জিত কোনো কিছু কিংবা হাস্যকর বোঝাতে স্কিবিডি (Skibidi) শব্দের ব্যবহার হয়। ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুটি অর্থেই এই শব্দের ব্যবহার রয়েছে। ইফ ইউ নো, ইউ নো (If you know, you know)–এর সংক্ষিপ্ত রূপ আই ওয়াই কে ওয়াই কে (Iykyk). কোনো একটি বিষয়ে কেউ আগে থেকে অবগত থাকলে শব্দটি ব্যবহার করে তার ইঙ্গিত দেয়। ইতিবাচক, মজার, বিস্ময়কর, দারুণ, চমৎকার বা “কুল”অর্থে লিট শব্দের ব্যবহার করে তারা। আদর করে পছন্দের মানুষ, বিশেষত বন্ধু ও ভালোবাসার মানুষকে “পুকি” ডাকা হয়। ইংরেজি “কারিজমা” শব্দটি থেকে রিজ (Rizz)। বাংলায় যেটাকে কারিশমা বা আকর্ষণী শক্তি কিংবা মাধুর্য বোঝায়। কারও কথা, চলনবলন বা ব্যক্তিত্ব কতটা আকর্ষণীয়, জেন-জি’র ছেলেমেয়ার তা বোঝাতে “রিজ” শব্দ ব্যবহার করে। কারও প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল হয়ে পড়া। বিশেষ করে কোনো নারীর প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল হয়ে পড়াকে সিম্প (Simp) বলা হয়।
বাংলাদেশে জেন জি কারা?
বাংলাদেশে যারা প্রায় ২০০০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা মূলত জেন জি। অর্থাৎ, ২০২৫ সালে তারা প্রায় ১৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী। জেন জি প্রজন্ম এমন এক মোড়ের দিকে যাচ্ছে, যেখানে তাদের হাতেই আছে ভবিষ্যতের সমাজ, প্রযুক্তি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি পুনর্গঠনের ক্ষমতা। এই প্রজন্মকে বোঝা ও বোঝানো—সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। যেমন তাদের কমন কিছু বৈশিষ্ট্য:
ক. অনলাইন শিক্ষা ও ইউটিউবনির্ভর জ্ঞান অর্জন। তবে বিশ্বজুড়ে জেনারেশন জি-এর সদস্যরা পূর্বের তুলনায় ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোতে বেশি সময় ব্যয় করছে এবং বই পড়ার জন্য কম সময় দিচ্ছে তাতে করে যুবকদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা এবং মানসিক ব্যাধির নির্ণয়ের সম্ভাবনা পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় বেশি বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
খ. ফেসবুকের বদলে টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে বেশি সক্রিয়। স্মার্টফোন, ইউটিউবের মাধ্যমে বড় হওয়া এক প্রজন্ম। লালন সাঁইজী, কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান বা কবিতা জেন জি রিমিক্স সংস্করণে উপস্থাপন করতে চায়।
গ. নিজস্ব মত প্রকাশে স্পষ্ট ও স্বাধীনচেতা। সংস্কৃতিচর্চা বলতে তারা বোঝে সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর—নাচ, গান, ফ্যাশন, রিল ভিডিও ইত্যাদি। ২০০০ ও ২০১০-এর দশকে এশিয়ার শিক্ষকেরা সেরা শিক্ষার্থী খুঁজে বের করে তাদের উন্নতিতে মনোনিবেশ করেন। তবে পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জোর দেওয়া হয়েছিল দুর্বল পারফরমারদের ওপর। ২০১০-এর দশকে পূর্ব এশিয় এবং সিঙ্গাপুরিয় শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরীক্ষাগুলিতে ধারাবাহিকভাবে শীর্ষস্থান অর্জন করেছিল-গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ঘ. ধর্ম ও সংস্কার বিষয়ে প্রশ্নকর্তা হলেও সংস্কৃতিকে ধারণ করে। আমি কে?” এই প্রশ্নে আগের প্রজন্মের তুলনায় জেন জি বেশি আত্মবিশ্লেষণী। ধর্মীয়, লিঙ্গ পরিচয়, অঞ্চল বা ভাষাগত পরিচয়ে বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিতে চায়।
ঙ. চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী।
চ. ট্রেন্ড, ফ্যাশন ও গ্লোবাল কালচারে দক্ষ। সিনিয়র সিটিজেনদের অনেকেই যা ইতিবাচক নেন না। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, কোভিড ১৯ এর ফলে এদের এমন অবস্থা। কেউ আবার এদের কালচারটাকে একেবারেই সহ্য করতে না পেরে নানাভাবে কটুকথা বলে থাকেন। কারণ সিনিয়র সিটিজেন মনে করেন, অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতা মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় তাদের। শর্ট অ্যাটেনশন স্প্যান তথা গভীর চিন্তা ও পাঠচর্চার অভাব তাদের রয়েছে। ভার্চুয়াল বাস্তবতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতাও তাদের চরিত্রে বিদ্যমান।
বাংলাদেশে এ ধারণা যেভাবে এসেছে:
বাংলাদেশে এই ধারণা এসেছে কর্পোরেট গবেষণা, মার্কেটিং থিওরি, সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড এবং পশ্চিমা একাডেমিক প্রভাব থেকে। তার আগে এ শব্দটি খুব বেশি কেউ খুঁজে পাননি।
১. বহুজাতিক ব্র্যান্ড ও মার্কেটিং: পণ্য বিক্রয়ের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা করতে থাকে কোন প্রজন্ম কোন ধরণের পণ্য ব্যবহার করে। এভাবে Gen Z একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট গ্রুপে পরিণত হয়। এ কারণেই বাংলাদেশে জেন জি নিয়ে মার্কেটিং কৌশল তৈরি হয়। গ্লোবাল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে জ্ঞান ও সংস্কৃতি গ্রহণ করায় বহুজাতিক কম্পানি তাদের ব্যাপারটি আমলে নেয়।
২. সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে: ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকের মাধ্যমে তরুণরা নিজেদের লাইফস্টাইল, চিন্তাভাবনা, ফ্যাশন, ট্রেন্ড প্রকাশ করতে থাকে। তখন সমাজবিজ্ঞানীরা এবং সাংবাদিকরা এই প্রজন্মকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে শুরু করেন।
৩. একাডেমিক ও সাংবাদিক ভাষায়: সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, মিডিয়া স্টাডিজ এবং যুবসমাজ বিষয়ক গবেষণায় “Gen Z” শব্দটি বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পত্রিকা ও টক শোতেও এই শব্দ এখন নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে।
৪. উন্নত বিশ্ব থেকে প্রভাবিত: পশ্চিমা দেশগুলোতে Gen Z নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়ায় বাংলাদেশেও বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গুলো বিষয়টি গ্রহণ করতে থাকে। আগের প্রজন্ম রাজনৈতিক দলভিত্তিক ছিল, জেন জি মূলত বিষয়ভিত্তিক (issue-based) সচেতনতা প্রদর্শন করে। যেমন: জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার, LGBTQ+ অধিকার, ধর্মীয় সহনশীলতা ইত্যাদি। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনৈতিক ট্রল ও মেম কালচার-এর মধ্য দিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করে।
জুলাই রেভল্যুশন কি কোন প্রেক্ষাপট তৈরী করেছিল?
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলা জুলাই বিপ্লব মূলত ছিল বেতনভিত্তিক ৩০% সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের দাবিতে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ আন্দোলন । সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধের আদেশ, কারফিউ, হামলা এবং ছাত্র হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। পুলিশ ও RAB-এর হাতে মারা যায় অনেক। যেটি পরে জুলাই গণহত্যা নামে পরিচিতি পায়। এই পরিস্থিতিতে সামরিক-পুলিশ বাহিনী, মধ্যবিত্ত ও নাগরিক সমাজের সচেতন অংশ আন্দোলনে শরীক হয় এবং শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে চলে যান । এ ঘটনার আগে পরে জেন জি’র রয়েছে বিশাল ভূমিকা। আন্দোলনে থাকা শত শত তরুণেরা ছিল “বিশেষজ্ঞ ডিজিটাল নেটিভ।” তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে তারা দ্রুত সংগঠন ও বার্তা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় । ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনায় কিছু সময় বিরতি পড়লেও তারা VPN, মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিরোধ করে । ক্রমশ তারা ফুঁসে উঠেছিল সরকারের নানা ধরণের নীতির বিরুদ্ধে। নেতা নির্দিষ্ট না থাকায় আইনশৃঙ্কলাবাহিনী তাদের ধরতে পারে না। তবে তারা কিছুসংখ্যক সমন্বয়ক নির্বাচিত করতে সমর্থ হয়েছিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা প্রচারমূলক প্রয়াস চালায়।
এমনকি তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার শ্লোগান দেয়। এটিও ছিল তাদের ব্যজস্তুতিমূলক (আইরনি) প্রতিবাদ। সাধারণ নাগরিক, শিক্ষক, মিডিয়া, আইনজীবী, শিল্পী, সেনা কর্মকর্তাদের একটি অংশ সমর্থনও করে। শুরুতে কোটা বাতিল দাবি ছিল, পরবর্তীতে ‘Hasina resign’ এবং আইন-শৃঙ্খলা থাকা পর্যন্ত তাদের অবস্থান অটল ছিল। পরে স্টেপ ডাউন হাসিনা (#stepdownhasina) হ্যাশট্যাগ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ফেসবুকের আইডি তারা পরিবর্তন করে ফেলে। ছবির বদলে তারা লাল বৃত্তে ভরাট করে ততোধিক প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। প্রাচীন শাসকগোষ্ঠীর ‘নিয়ন্ত্রিত মৌনতা’ প্রযুক্তি-মনস্তত্ত্বের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে যায়। এবং আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সংবাদমাধ্যম অনেক খবর চেপে গেলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়া তা উগরে দিয়েছিল নির্বিবাদে। ফলে তারা প্রমাণ করে দেয় যে, সামাজিক রাষ্ট্র কাঠামোর দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তারাও রাজনৈতিক বৃহত্তর পরিবর্তন আনতে সক্ষম। উন্নত প্রযুক্তি, ডিজিটাল প্লাটফর্ম ও বিকেন্দ্রীভূত সমন্বয় ক্ষমতা তাদের রয়েছে-এটিও প্রমাণ হয়।
তাছাড়া জেন জি’দের কাছে শেখ হাসিনা সরকারের অনেক অনিয়ম ও নেতৃবেৃন্দের ব্যবহার বিষের মতো তেতিয়ে উঠেছিল। ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রশংসিত হলেও সময়ের সাথে সাথে মানবাধিকার হ্রাস, বাক-স্বাধীনতার সংকোচন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও নির্বাচনব্যবস্থার প্রশ্নবিদ্ধতার জন্ম দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সরশিপ তারা একেবারেই পছন্দ করেনি। ২০২০–২১ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় ছিল তারা। তাছাড়া চাকরি সংকট ও শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতায় ক্ষতিগ্রস্ত জেন জি প্রজন্ম। জেনারেশন জি-এর কিশোর-কিশোরীরা পুর্ববর্তী প্রজন্মগুলোর তুলনায় একাডেমিক পারফরম্যান্স এবং চাকরির সুযোগ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। মেধাবীরা বিদেশে চলে যেতে চায়, যা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা বলে তারা গন্য করেছে। এই সুযোগে প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইটস গ্রুপে সরব হয়ে পড়ে। তারা পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে জেন জি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষেত্রে এরা যে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সরকার তখন বিশ্বাস ও আমলে নেয়নি। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে তারা তা প্রমাণ করেছে। এরা মূলত আওয়ামী লীগ বা বিএনপি থেকে দূরে থাকতে চায়। তারা কোনো নতুন, নৈতিকতাভিত্তিক তৃতীয় শক্তিকে সমর্থন করতে চায়। সাম্প্রতিক তারা সাংগঠনিকভাবে ছিন্নভিন্ন। এদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে নিরাসক্ত বা হতাশ। তবুও যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ উত্তাল হয় — বিশেষ করে কোনো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে Gen Z বড় ট্রিগার হয়ে উঠতে পারে তখন-এমন ধারণা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।