
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এক অদ্ভুত নিদান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন আদমশুমারি ফর্মে যাঁরা মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা লিখেছেন, তাঁদের সংখ্যা হিসেব করলেই বোঝা যাবে অসমে বিদেশি রয়েছেন কতজন। কথাটি শুধু হাস্যকর নয়, ভয়ংকর। বিশেষ করে সারাদেশের বিভিন্ন রাজ্যে যখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক যাঁরা বাংলায় কথা বলছেন তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে অনেকক্ষেত্রেই এমনকি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কাজও শুরু হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, আসামের সরকার কোচবিহারের এক বাসিন্দাকে ইতিমধ্যেই তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার চিঠি ধরিয়েছে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আজ বলা উচিত, এগুলি ঘোর অন্যায় হচ্ছে।
ভাষা চিরকালই রাজনীতির অংশ; গোটা পৃথিবী জুড়েই। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের একটি বড়ো অংশেই, বেশ কতগুলি দেশে, সেই দেশের ভাষায় কথা বলেন না যাঁরা, তাঁদের দ্রুত বিদেশি হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়, তাতে যতই না তাঁরা সরকারি নিয়মমতে সেই দেশের নাগরিক হন! এমনকি সেই দেশের ভাষায় কথা বললেও উচ্চারণের তারতম্যের কারণেও অন্য দেশ থেকে আসা সেই দেশের একজন নাগরিককে সারা জীবনই বয়ে বেড়াতে হয় ‘বিদেশি’ অপবাদের তকমা। কাজেই নাগরিকত্ব চিহ্নিতকরণের কাজে সাধারণ মানুষ অনেক সময়ই ভাষাকে হাতিয়ার করে থাকেন। কিন্তু একটি নির্বাচিত সরকার এই কাজ করতে পারে কি? স্পষ্ট উত্তর হল, না।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মা যে-কথা বলেছেন, তাতে জাতিবিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষ রয়েছে। কারণ তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য কেবলমাত্র বাঙালিরাই নন, স্পষ্ট করে বললে বাংলাভাষী মুসলিমরা। অসমের একটি বিরাট বড় অংশের বাংলাভাষী মুসলিমরা বসবাস করেন। তিনি বলতে চেয়েছেন যে, এঁদের অনেকেই অনুপ্রবেশকারী। সন্দেহ নেই যে, দেশভাগের দগদগে ক্ষত আজও শুকিয়ে যায়নি বলেই, অনুপ্রবেশ আমাদের দেশে একটি বড়ো সমস্যা। আজও বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীরা আমাদের দেশে চলে আসেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্ব তো মূলত বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের, অর্থাৎ কেন্দ্রের। সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতাকে রাজ্যগুলির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা বিজেপি দীর্ঘদিন ধরেই করে চলেছে। অসমে তো সেই সুযোগও নেই! আসামে তো বিধানসভার দখল বিজেপিরই। বিজেপির অবস্থান অনুযায়ী অনুপ্রবেশের জন্য দোষী করতে গেলে, এখানে দোষী করতে হয় রাজ্য সরকারকেই। আরও বড় প্রশ্ন হল এই যে, অনুপ্রবেশকারীদের কি কেবল ভাষা ব্যবহার দিয়ে চিহ্নিত করা সম্ভব, নাকি উচিত?
অনেকেই বলতে পারেন যে, এই বাঙালিবিদ্বেষ অসমে নতুন কিছু নয়। ঠিক কথা। অতীতেও বাঙালিদের অসম ছাড়ার নিদান দেওয়া হয়েছে। ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলন হয়েছে। বাঙালিদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, অসমে অসমিয়া মাত্রই কি বাঙালিবিদ্বেষী?
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিই। এনআরসির প্রথম তালিকা প্রকাশ পেয়েছে অসমে। বাদ গিয়েছে একাধিক বাঙালির নাম। কেবল মুসলিম বাঙালি নয়, হিন্দু বাঙালিদের নামও বাদ গিয়েছে। সেই তালিকার মধ্যে রয়েছেন বেশ কিছু সর্বভারতীয় স্তরে স্বীকৃত বাঙালি। পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। সেই অবস্থাতেই আমার এক বাঙালি কবি বন্ধুর কবিতার অসমিয়া অনুবাদের বই প্রকাশ পাবে গৌহাটিতে। বইটি সম্পর্কে দু'কথা বলতে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বইটির প্রকাশক। অনুষ্ঠানটির আয়োজক অসম সাহিত্য সভা। এই সংগঠনটি একটি ঐতিহ্যশালী সংগঠন। একে মান্যতা দেওয়া হয় কেবলমাত্র অসমেই নয়, গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই। অতীতেও আমি অসম সাহিত্য সভার অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তাই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আমন্ত্রণ আসার পর আমি দ্বিতীয়বারের জন্য ভাবিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে। সেই অনুষ্ঠানে যে-অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বহুদিন মনে থাকবে। যে-উষ্ণ আপ্যায়ন অসম সাহিত্য সভার কর্তাব্যক্তিদের থেকে পেয়েছিলাম তা অতুলনীয়। বাঙালি অসমিয়া বিদ্বেষের লেশমাত্র ওই অনুষ্ঠানে ছাপ ফেলতে পারেনি। ভেবে দেখুন, সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে অসম সাহিত্য সভায় প্রকাশ পাচ্ছে একজন বাঙালি কবির অসমিয়া বই। প্রকাশ করছেন আরেকজন বাঙালি কবি। আসলে অসমের একটি বৃহত্তর অংশের মানুষের মধ্যেই আজ আর সেই অর্থে বাঙালি বিদ্বেষ নেই। বাংলা ভাষাটি যদিও ওখানে যথেষ্ট কোণঠাসা। তার নানা অন্যান্য কারণ আছে। কিন্তু আমি নিজে দেখেছি যে, অসমিয়া সাহিত্যিকদের একটি বড় অংশ যেমন বাংলা সাহিত্যের অসমিয়া অনুবাদ করে থাকেন, তেমনই বাংলা লেখক যাঁরা অসমে আছেন, তাঁরাও নিয়মিতভাবে অনুবাদ করে থাকেন অসমিয়া সাহিত্য। কাজেই, বাংলা ভাষার প্রতি ঘৃণা অসমের একটি সামগ্রিক চিত্র নয়।
যেকথা অসমের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তা আসলে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান। রাজনৈতিক অবস্থান বিজেপি দলটিরও। মানুষে মানুষে বিভাজনের যতগুলি পন্থা আছে, এই সবকটি পন্থাকেই ভোটের রাজনীতির কারণে এই দলটি ব্যবহার করে থাকে। দলটির একাধিক নেতার কথাবার্তায় সাম্প্রতিক অতীতেও মুসলিম বিদ্বেষ এবং বাঙালিবিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। দলটি মাথায় রাখছে না যে, প্রতিবেশী রাজ্য অসমের মুখ্যমন্ত্রী বাংলা ভাষা নিয়ে এই ধরনের মন্তব্য করলে তার ব্যাপক প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালিরা এই ধরনের মন্তব্যকে কিছুতেই ভাল চোখে দেখবেন না। এই ধরনের মন্তব্য যতই বিজেপি দলটির নেতারা করতে থাকবেন, ২৬-এর নির্বাচনে এ-রাজ্যে ততই তাঁরা পিছিয়ে পড়তে থাকবেন।
বিজেপি আসলে ভারতীয় সভ্যতার মূল সুরটিকে আজও ধরতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ভারতের নানা রাজ্যে নানা কারণে নির্বাচনে এই দলটি জয়লাভ করে একথা ঠিক। কিন্তু দলটি কখনোই ভারতীয় সভ্যতার মূল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মান্যতা দেয় বলে মনে হয় না। দিলে বুঝত যে, বৈচিত্র্য এবং বিভাজনের মধ্যে তফাৎ আছে। বৈচিত্র্যকে কখনওই বিভাজনের রাজনীতিতে কাজে লাগানো উচিত নয়। ভারতীয় সভ্যতা চিরকাল বৈচিত্র্যের পক্ষে থেকেছে, বিভাজনের পক্ষে নয়।