যাহা রটে তার পুরোটা না হোক কিছু হলেও বটে। তামিমের দাম্ভিকতা তথা রগচটা মনোভাব একটি পুরনো ওপেন সিক্রেট বিষয়। একই বিষয় সাকিবের মাঝেও বিদ্যমান। তারা উভয়েই এসব নিয়ে বহুবার নিজেরা ভূগেছেন ও পাপন সাহেবকে ভূগিয়েছেন। তাদের দুজনের সম্পর্কের টানাপোড়ন নতুন কিছু নয় কিন্তু মাঝখানে মাশরাফি থাকাতে এসব নিয়ে কাওকে কখনই ভাবতে হয়নি। এখন মাশরাফি নেই আর তার বিকল্পও নেই। একজন সাকিব বা একজন তামিম কখনই একজন মাশরাফির বিকল্প হতে পারবেনা। মাশরাফিকে সুপার ক্রিকেট কিংবদন্তী বলা যেতেই পারে। তবে সাকিব তামিম দুইয়ে মিলে মাশরাফির বিকল্প হতে পারে।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লালসালু উপন্যাসের একটি ডায়লগ হচ্ছে- ক্যায়া এক ঘরমে দো পীড়, যাও বাচ্চা শুয়ো রোহ। ঠিক এই মূহুর্তে একজনকে শুয়াতে হবেই আর সেক্ষেত্রে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তামিমকেই সিলেক্ট করা হবে, এটিই স্বাভাবিক। পাপন সাহেব সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। এখন যদি তামিমকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ক্যাপ্টেন সিলেক্ট করা হত তাহলে একইরকম সমস্যা সাকিবের দ্বারা তৈরি হতো এবং হতই। এর প্রধান কারন তারা উভয়েই বর্তমানে কেপ্টেন্সি কেন্ডিডেট। সুসম্পর্ক থাকলে এটা কোনো ব্যাপারনা আর সম্পর্ক ভালো না থাকলে বিষয়টি অনেক কিছু। কারন ম্যাচ চলাকালীন সময়ে এর প্রভাব ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করে যা পরবর্তীতে লজ্জাজনক হার হওয়ার মতই ঘটনা ঘটে বেশীরভাগ সময়।
পাপন সাহেবের বর্তমানে অনেক সমালোচক কিন্তু তারই নেতৃত্বে/ব্যবস্থাপনায় বিগত দিনের বাংলাদেশ ক্রিকেটের বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্জন আছে যার জন্য পাপন সাহেবের অনেক অনেক আলোচকও আছে।
বিগত দিনের সকল আলোচনা সমালোচনা বাদ দিলাম। শুধুমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তামিমের আমন্ত্রণের বা একান্ত সাক্ষাতের পর থেকে আলোচনা করা যাক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি স্নেহ প্রদানের পরে আর দাম্ভিকতা চলেনা, আর কোনো অভিমানও চলেনা।
ধরে নিলাম পাপন সাহেবের অনেক দোষ বাট সেই ঘটনার পরে পাপন সাহেব কিছুটা হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্নেহহেয় হয়েছেন, একথা সত্য। কারন এই বিষয়গুলো দেখভাল করা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নয় বরং এগুলো দেখার জন্যই পাপন সাহেবকে বিসিবির সভাপতি করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে- পাপন সাহেব প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সাহেবের ছেলে। তাকে প্রধানমন্ত্রী চাইলে অনেক বড় মাপের কোনো মন্ত্রীও বানাতে পারতেন বাট তা না করে এই সেনসিটিভ দায়িত্ব দিয়েছেন। ভুল বা মিস মেনেজম্যান্ট হতেই পারে বাট কোথাও না কোথাও বিশ্বাসের একটি মেলবন্ধন রয়েছে; তানাহলে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পাপন সাহেব এতদিনে দায়িত্ব থেকে ফায়ার হয়ে যেতেন।
যাইহোক, তামিম অধিনায়কত্ব বা অবসর নিয়েছিলেন তারই ইচ্ছায়; তাকে কিন্তু অফিসিয়ালি বাদ দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী অভিমান ভাঙ্গালেন। ব্যাস! এরপর থেকে তামিমের টিমম্যানের আওতায় চলে আসা উচিত ছিলো। নেতৃত্বে পরিবর্তন আসলে সিষ্টেমেও পরিবর্তন আসবে, এটাই স্বাভাবিক। এটা মেনে নিতে হবে সবাইকে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাই পাপন সাহেব তাকে ফোন দিয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছিলো তা এভাবে নগ্নভাবে প্রেজেন্ট করা তার উচিত হয়নি।
তারই কথায় প্রকাশ যে, সে নাকি উত্তেজিতও হয়ে গিয়েছিলো। একটি সময় ছিলো যখন নীতিনির্ধারকদের এধরনের প্রস্তাব তারা প্রায়ই শোনত এবং মেনেও চলত এবং দলের সফলতাও ছিলো ধারাবাহিক । আজ তারা অনেক বড় বড় ষ্টার হয়ে গেছে; এমনকি অনেক টাকাওয়ালাও, তাছাড়া চাচার পরিচয় ত আছেই। এখন আবার সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথেই তার যোগাযোগ হয়ে গেছে ভালো। তাকে আর ঠেকায় কে?
স্বয়ং বিসিবি সভাপতির সাথেই যদি সে উত্তেজিত হয়ে যায় তাহলে এই প্রস্তাবটি যদি ক্যাপ্টেন হিসেবে সাকিব তাকে দিতো দেন কি হত ? যা হতো তা খুবই মন্দ হতো। তামিমের ভিডিও বার্তার পর প্রশ্নবিদ্ধ বাংলাদেশ ক্রিকেট; এমনকি প্রশ্নবিদ্ধ বাংলাদেশ। স্পষ্ট প্রতীয়মান এই যে, তামিমের সাথে সাকিব ও পাপন সাহেবের বিরোধ সরাসরি। এসব নিয়ে আর যাইহোক সুস্থভাবে খেলাধুলা করা যায়না। পাবলিক সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে দাম্ভিকতাকে ঢাকা যায়না। তামিম নি:সন্দেহে একজন ভালো ক্রিকেটার, ভরসা করার মতো ক্রিকেটার। এর বহু প্রমাণও রয়েছে দেশি ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলে। অন্তত আসন্ন বিশ্বকাপে তামিমের অনুপস্থিতি বাংলাদেশ দলের জন্য কখনই ইতিবাচক নয়।
কিন্তু তাকে ক্যাপ্টেন্সি এবং ওপেনিং ত দিতেই হবে এমনকি তার পছন্দমত প্লেয়ারও বাছাই করতে হবে। শুধু তাই নয় যা দৃশ্যমান তাতে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে- সাকিবের নেতৃত্বে সে সঠিকভাবে চলবেনা ও খেলবেওনা; এমনকি বিসিবির সভাপতিও তার পছন্দ নয়, এখানেও পরিবর্তন আনতে হবে। বিষয়টি এমন যে, তামিমকে প্রাধান্য দিয়ে সাকিব ও পাপন সাহেবকে বরখাস্ত করা হোক। এ কাজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কখনই করবেননা কারন প্রধানমন্ত্রীকে সার্বিক দিক ভেবে জাতীয় কল্যাণ বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
‘‘আজ যদি সাকিবের জায়গায় তামিম যেতো তাহলে সাকিবের ভাগ্যেও এমনি ঘটতো যা তামিমের ভাগ্যে চলমান। সাকিবও এভাবেই বলতো যেভাবে তামিমের ভাষ্য চলমান। অন্যদিকে ক্রিকেট ভক্তরাও সাকিবের পক্ষে এভাবেই বলতো যেভাবে তামিমের পক্ষে ভাষ্য চলমান’’।
বাস্তবিক আচরণে তামিম সাকিব তারা উভয়ে অনেকটাই একে অপরের পরিপূরক হলেও একথা স্পষ্ট যে, দাম্ভিকতার দিক দিয়ে সাকিবের চেয়ে তামিম একটু বেশীই এগিয়ে আছেন কারন তামিমের চাচা আছেন। মাশরাফির বিদায়ের পর বাংলাদেশ টিমটাই যেনো একজন তামিমের কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। যেনো তামিম ছাড়া বাংলাদেশ টিম অচল।
এজন্যই হয়তো একক নির্ভরশীলতা কাটিয়ে সার্বিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ টিমে। তাই এবার অনেকটাই কঠোর হতে হয়েছে বিসিবি প্রেসিডেন্টকে কারন দলের সফলতা হলে তা খেলোয়ারদের প্রাপ্য হয় আর ব্যার্থতার পুরোটাই আসে বিসিবির সভাপতির ঘারে। তাই তাকে বারবার রিস্ক নিতেই হয় আর এধরনের রিস্কি শটে বিগত দিনে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সফলতা আছে বিসিবি সভাপতির, একথাও সত্য। তবে এবারের রিস্কটা অনেকাংশেই হাই রিস্ক হয়ে গেছে। তাই এবারের বিশ্বকাপে বিসিবি সভাপতির সফলতা বাধ্যতামূলক। যদি তা না হয় তবে আসন্ন বিশ্বকাপের পরে হয়তো বিসিবি সভাপতিরও বিদায় ঘন্টা বাজতে পারে বৈকি।
শুধু ভালো খেলোয়ার হলেই হবেনা ভালো ব্যক্তিত্বের অধিকারীও হতে হবে নয়তো প্রতিভা বা ফর্ম থাকা স্বত্বেও সময়ের আগেই ঝড়ে যেতে হবে চলমান তারকাকে। এমন বহু ঘটনা বিশ্বের বহু গ্রেট প্লেয়ারদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে এবং তা ঘটতেই থাকবে। একজন ভালোমানের খোলোয়ার শুধুই দেশের জন্য খেলে যাবে এটাই তার প্রফেশনাল রেসপন্সিবিলিটি। রাজনীতি বা কুটনীতি একজন ভালো খেলোয়ারের বৈশিষ্ট হতে পারেনা। প্রফেশনালিজম কোনো সহজ বিষয় নয়। যাদের অধিনে প্রফেশনালি দায়িত্ব পালন করতে হয়, বিনিময়ে সম্মানি নিতে হয়, তাদের সাথে যুদ্ধ নয় সমঝোতা করে চলতে হয়। বাধ্যগত না হলেও অনুগত থাকতে হয়।
প্রফেশনাল মাঠে কোনো নীতিনির্ধারকই তাদের অধিনস্তদের গুরুত্বহীনতা তথা বেয়াদবিকে প্রশ্রয় দিবেনা। যদি তা হতোই তাহলে এতো এতো বর্ষিয়ান নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ পড়তেননা। শুধু ভাবনার নয়, বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবনের বিষয়। মানলে মানবে না মানলে মানে মানে কেটে পড়বে যেনো কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করতে না পারে কখনও। তামিমও তাই করেছিলো কিন্তু তার অবসর নেওয়ার সময়টিও ছিলো বিতর্কিত, এতে তখন দলের সবাই ছন্দ হারিয়েছিলো, পুরো টিমটাই মাঝ পথে বিপাকে পড়েছিল যা বিসিবি সভাপতির সামাল দিতে অনেক ঝামেলা হয়েছিলো । পদত্যাগটি এর আগে পরেও করা যেতো যদি তার উদ্দেশ্য ভালো হতো। এক কথায় তামিমের সেই পদত্যাগটিই ছিলো উদ্দেশ্য প্রণোদিত ।
শেষকথা হচ্ছে, এবার বিশ্বকাপে ভালো খেলুক বাংলাদেশ, এই কামনা ছাড়া আর কোনো সমালোচনা না করাই ভালো তামিমের জন্য। তাহলে হয়তো বিতর্কিতভাবে পারমানেন্টলি তামিমের বিদায় ঘন্টা বাজবে জাতীয় ক্রিকেট থেকে। আর যদি ভালো না করে তাহলে আবারও তামিম হবে হিরো আর সাকিব হবে জিরো আর পাপন সাহেব হবেন কবিতার স্বপনবুড়ো। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, হ্যন্সি ক্রনিয়ে, মো: আজহার উদ্দিন সহ এমন আরও বহু উদাহরণ রয়েছে যাদের থেকে তামিমকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। ধন্যবাদ
(লেখক: এম আনিছুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক, , ফ্রন্টিয়ার রিপোর্টার্স সোসাইটি অব বাংলাদেশ (FRSB), ঢাকা জেলা শাখা)