চীন দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতও হয়ে উঠছে এক গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প ও সম্ভাবনাময় বাজার। ভৌগোলিক সান্নিধ্য, সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা এবং ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক বাণিজ্য চাহিদা—সব মিলিয়ে ভারত এখন বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন দরজা খুলে দিতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সংযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের আগ্রহ বাড়ায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্যও সুযোগের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য ভারত যে বহুমাত্রিক সুবিধা দিতে পারে, তা কয়েকটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ—
বৃহৎ বাজারে প্রবেশাধিকার: ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি এবং দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাজার। ১৪০ কোটিরও বেশি ভোক্তা এই বাজারে বাংলাদেশের পণ্য—বিশেষ করে তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য, চামড়া ও ওষুধ—এর জন্য বড় সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ভারত ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ও হালকা প্রকৌশল পণ্য আমদানি শুরু করেছে, যা আগামী বছরগুলোতে আরও বাড়তে পারে।
পরিবহন ও ট্রানজিট সুবিধা: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলবন্দর, রেল ও নদীপথের সংযোগ দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। আগরতলা, দাউকি, বেনাপোল, তামাবিলসহ বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন সহজ হচ্ছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের সুযোগও বাড়ছে, যা দুই দেশের ব্যবসায়ী উভয়ের জন্যই সময় ও খরচ সাশ্রয় করবে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারে ভারতের ট্রানজিট চুক্তি ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে—এটি বাংলাদেশের লজিস্টিকস খাতে নতুন আয়ের সুযোগও সৃষ্টি করছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সহযোগিতা: ভারত ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করছে। ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি—বিশেষ করে সৌর ও বায়ু শক্তি—ক্ষেত্রে যৌথ বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান শিল্পচাহিদা মেটাতে ভারতীয় জ্বালানি সহযোগিতা ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ব্যয় কমাতে সাহায্য করতে পারে।
শিল্পাঞ্চল ও বিনিয়োগ অংশীদারিত্ব: ভারতীয় কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশের শিল্পখাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর, কুষ্টিয়া ও মিরসরাই অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিকল্পিত হচ্ছে। এতে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যাল, অটোমোবাইল ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে।
মুদ্রা লেনদেন ও ব্যাংকিং সহযোগিতা: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সরাসরি টাকার বিপরীতে রুপিতে লেনদেনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে। যদি এটি কার্যকর হয়, তবে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা ডলারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দ্রুত ও স্থিতিশীল বাণিজ্য করতে পারবেন।
দক্ষতা ও প্রযুক্তি বিনিময়: ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্য খাত তুলনামূলকভাবে উন্নত। এসব খাতে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি স্থানান্তর বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন দিগন্ত খুলতে পারে। বিশেষ করে ডিজিটাল অর্থনীতি, স্টার্টআপ ও ই-কমার্স খাতে ভারতীয় অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক যদি ভারসাম্যপূর্ণভাবে পরিচালিত হয়, তবে এটি শুধু অর্থনীতিতেই নয়, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে একই সঙ্গে তারা সতর্ক করছেন—বাণিজ্য ঘাটতি, অশুল্ক বাধা এবং সীমান্তপথে জটিল প্রক্রিয়া যদি কমানো না যায়, তবে এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো কঠিন হবে। সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এখন শুধু চীন নয়, ভারতের দিকেও তাকিয়ে আছেন—যেখানে আছে বিশাল বাজার, যৌথ বিনিয়োগের সম্ভাবনা, আর আঞ্চলিক বাণিজ্য সংযোগের নতুন দিগন্ত। দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও নীতিগত সমন্বয় বাড়লে ভারত বাংলাদেশের জন্য হতে পারে পরবর্তী “বাণিজ্যিক সুখবরের” দেশ।
