বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও কূটনীতিতে এক গভীর ও জটিল বাস্তবতা। ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক নির্ভরতা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা—সব মিলিয়ে এই সম্পর্ক কখনো সহযোগিতার, কখনো সংশয়ের। সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্ন উঠছে, এই সম্পর্ক আসলে কোন পথে এগোচ্ছে—সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক স্বার্থের দিকে, নাকি একতরফা নির্ভরতার দিকে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্মৃতিতে বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সরকার পরিবর্তন এবং আঞ্চলিক কৌশলগত বাস্তবতা সেই সম্পর্কের চরিত্র বারবার বদলে দিয়েছে। আবেগনির্ভর ঐতিহাসিক সম্পর্ক ধীরে ধীরে বাস্তববাদী ও স্বার্থনির্ভর কূটনীতিতে রূপ নিয়েছে। বর্তমান সময়ে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। নিয়মিত শীর্ষ বৈঠক, চুক্তি স্বাক্ষর এবং সহযোগিতার ঘোষণাগুলো সেই দাবিকে শক্তিশালী করে। তবে বাস্তবতায় দেখা যায়, সীমান্ত হত্যা, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত—যেমন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও এনআরসি—বাংলাদেশের জনমনে উদ্বেগ ও ক্ষোভ তৈরি করেছে। প্রশ্ন উঠছে, এই অংশীদারিত্বে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হলেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা স্পষ্ট। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের রপ্তানি অনেক বেশি, ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ছে। ভারতীয় ঋণ ও লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, যা একদিকে উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করলেও অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নির্ভরতার আশঙ্কাও উত্থাপন করছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জাতীয় স্বার্থ কতটা নিশ্চিত হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় দুই দেশ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ নীতিগত সহায়তা দিয়েছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। তবে এর বিনিময়ে বাংলাদেশ কী ধরনের নিরাপত্তা সুবিধা পাচ্ছে এবং সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার বিচার ও জবাবদিহি কোথায়—এই প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর এখনো মেলেনি। পানি বণ্টন ইস্যু বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অধ্যায়। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে, অথচ এই নদীর পানির ওপর উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও জীবনযাত্রা নির্ভরশীল। উজানে বাঁধ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে ভাটিতে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ছে। এই সংকট শুধু কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়, বরং এটি মানুষের জীবন ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হোক, জনমতের ক্ষেত্রে সেই উষ্ণতা প্রতিফলিত হচ্ছে না। সীমান্ত হত্যা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যের আশঙ্কা সাধারণ মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছে। রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব যদি জনগণের আস্থায় প্রতিফলিত না হয়, তবে সেই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখন বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতির পথে হাঁটছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করছে ঢাকা। এতে ভারতের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হলেও বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট—জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি অপরিহার্য।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক এখন এক দ্বিধাবিভক্ত বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে। এখানে যেমন সহযোগিতার সুযোগ আছে, তেমনি অব্যবস্থাপনা ও অসমতার কারণে অসন্তোষও জমছে। এই সম্পর্ক টেকসই করতে হলে প্রয়োজন পারস্পরিক সম্মান, স্বচ্ছতা এবং সমতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। জনগণের স্বার্থ ও অনুভূতিকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক কোন পথে যাবে, তার উত্তর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ন্যায্যতা এবং আঞ্চলিক বাস্তবতাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় তার ওপর।
