বুধবার,

২৭ আগস্ট ২০২৫

|

ভাদ্র ১১ ১৪৩২

XFilesBd

ব্রেকিং

২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থ-উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। মোট বাজেট -৭,৯০,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা-৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি -২,২৬,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬%) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা-৫

বিশ্বকবির প্রয়াণ দিবসে বিশেষ নিবন্ধ

বাংলা ভাষার উপর জবরদস্তি বিষয়ক রবীন্দ্রভাবনা

   কামরুল ইসলাম 

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ৭ আগস্ট ২০২৫

আপডেট: ০৩:৪২, ৭ আগস্ট ২০২৫

বাংলা ভাষার উপর জবরদস্তি বিষয়ক রবীন্দ্রভাবনা

"বাংলা ভাষা'র উপর জবরদস্তি" কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শত বছর পূর্বে অনুভব করেছিলেন। সেই সময়ের  ( বৈশাখ, ১৩৩৩, সাহিত্যসম্মিলন ) তাঁর লেখা প্রবন্ধের কিছু অংশ উপস্থাপন করছি। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্যের উপর নানা সময়ে কর্তৃত্ববাদিদের নেতিবাচক অবস্থান, ধর্মীয় বিভেদ চাপিয়ে দিয়ে বাঙালির ঐক্যকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে।  এই অবস্থার পরিণতি কি হতে পারে, তা নিশ্চয়ই সকলে অনুভব করতে পারেন।

কবিগুরু বাংলা ভাষা, সাহিত্য, বাঙালি বিষয়ে যেসব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন, আজও তার পুনরাবৃত্তি কেন প্রাসঙ্গিক? রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতির জটিল আবর্তে বাংলা ভাষার উপর বিধি-নিষেধের মাধ্যমে বাঙালির জাগরণকে রোধ করতে চায়। ধর্মের নামে অধর্মের কূটচালে বাংলা ভাষার উপর বার বার জবরদস্তি লক্ষ্য করা যায়। যা বাঙালির ঐক্যকে বিনষ্ট করছে। সমকালেও বিদ্যমান অবস্থায় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালির অবস্থান কি হতে পারে, কি করা যায়, তা বোধকরি কবিগুরু পথনির্দেশ করে গেছেন।

"১. বাঙালি একটি সত্যবস্তু পাইয়াছে, ইহাই তাহার সাহিত্য। এই সাহিত্যের প্রতি গভীর মমত্ব স্বতই বাঙালির চিত্তকে অধিকার করিয়াছে। এইরূপ একটি সাধারণ প্রীতির সামগ্রী সমগ্র জাতিকে যেরূপ স্বাভাবিক ঐক্য দেয় এমন আর কিছুই না। স্বদেশে বিদেশে আজ যেখানে বাঙালি আছে সেখানেই বাংলা সাহিত্যকে উপলক্ষ করিয়া যে সম্মিলন ঘটিতেছে, তাহার মতো অকৃত্রিম আনন্দকর ব্যাপার আর কী আছে?

২.  বাংলা সাহিত্য বাঙালির মনের মধ্যে সেই ভিতরের আগুনকে সত্য করিয়া তুলিতেছে; ভিতরের দিক হইতে তাহার মনের দাসত্বের জাল ছেদন করিতেছে। একদিন যখন এই আগুন বাহিরের দিকে জ্বলিবে, তখন ঝড়ের ফুৎকারেৎসে নিবিবে না, বরং বাড়িয়া উঠিবে। এখনই বাংলাদেশে আমরা তাহার প্রমাণ পাইয়াছি;... বাঙালির অন্তরের মধ্যে বাংলা সাহিত্য অনেকদিন হইতে অগ্নিসঞ্চয় করিতেছে—।... শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নহে, তাহার চেয়ে দুঃসাধ্য সমাজক্ষেত্রেও বাঙালিই সকলের চেয়ে কঠোর অধ্যবসয়ে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করিয়াছে। পূর্ণ বয়সে বিবাহ, বিধবা বিবাহ, অসবর্ণবিবাহ, ভোজনপঙক্তির বন্ধনচ্ছেদ, সাম্প্রদায়িক ধর্মের বাধামোচন প্রভৃতি ব্যাপারে বাঙালিই সকলের আগে ও সকলের চেয়ে বেশি করিয়া আপন ধর্মবুদ্ধির স্বতন্ত্রকে জয়যুক্ত করিতে চাহিয়াছে।

৩. বাঙালির চিত্তের আত্মপ্রকাশ একমাত্র বাংলা ভাষায়, এ কথা বলাই বাহুল্য।... বাংলা সাহিত্যের ভিতর দিয়া বাঙালির মন যতই বড়ো হইবে, ভারতের অন্য জাতির সঙ্গে মিলন তাহার পক্ষে ততই হইবে।

৪. সম্প্রতি হিন্দুর প্রতি আড়ি করিয়া বাংলাদেশের কয়েকজন মুসলমান বাঙালি-মুসলমানের মাতৃভাষা কাড়িয়া লইতে উদ্যত হইয়াছেন।  এ যেন ভাইয়ের উপর রাগ করিয়া মাতাকে তাড়াইয়া দিবার প্রস্তাব।বাংলাদেশের শতকরা নিরানব্বইয়ের অধিক-সংখ্যক  মুসলমানের ভাষা বাংলা। সেই ভাষাটাকে কোণঠাসা করিয়া তাহাদের উপর যদি উর্দু চাপানো হয়, তাহা হইলে তাহাদের জিহবার আধখানা কাটিয়া দেবার মতো হইবে না কি। ... বাংলা যদি বাঙালি-মুসলমানের মাতৃভাষা হয়, তবে সেই ভাষার মধ্য দিয়াই তাহাদের মুসলমানিও সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ হইতে পারে।.....
কেহ কেহ বলেন, মুসলমানের ভাষা বাংলা বটে, কিন্তু তাহা মুসলমানি বাংলা, কেতাবি বাংলা নয়। স্কটল্যান্ডের  চলতি ভাষাও তো কেতাবি ইংরেজি নয়। স্কটল্যান্ড কেন, ইংল্যান্ডের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের প্রাকৃত ভাষা সংস্কৃত, ইংরেজি নয়। কিন্তু তা লইয়া তো শিক্ষা ব্যবহারে কোনোদিন দলাদলির কথা শুনি নাই। সকল দেশেই সাহিত্যিক ভাষার বিশিষ্টতা থাকেই। সেই বিশিষ্টতার নিয়ম বন্ধন যদি ভাঙিয়া দেওয়া হয়, তবে হাজার হাজার গ্রাম্যতার উচ্ছৃঙ্খলতায় খান্ খান্ হইয়া পড়ে।

৫. বাংলাদেশেও হিন্দু-মুসলমানে বিরোধ আছে।.... আগে মিলনটা সত্য হওয়া চাই, তার পরে পলিটিক্স সত্য হইতে পারে।.... বাংলাদেশে সৌভাগ্যক্রমে আমাদের একটা মিলনের ক্ষেত্র আছে। সে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য।  এইখানে আমাদের আদান প্রদানে জাতিভেদের কোনো ভাবনা নাই।  সাহিত্যে যদি সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিভেদ থাকিত তবে গ্রীক সাহিত্যে গ্রীক্-দেবতার লীলার কথা পড়িতে গেলেও আমাদের ধর্মহানি হইতে পারিত।... একদা নিষ্ঠাবান হিনন্দুরাও মুসলমান আমলে আরবি ফারসি ভাষার পণ্ডিত ছিলেন; তাহাতে তাঁহাদের ফোঁটা ক্ষীণ বা টিকি খাটো হইয়া যায় নাই। সাহিত্য পুরীর জগন্নাথক্ষেত্রের মতো, সেখানকার ভোজে কাহারও জাতি নষ্ট হয় না। 

৬. সাহিত্যে বাংলাদেশে যে একটি বিপুল মিলনযজ্ঞের আয়োজন হইয়াছে, তাহার বেদি আমাদের চিত্তের মধ্যে, সত্যের উপরে ভাবের উপরে যাহার প্রতিষ্ঠা, সেখানেও হিন্দু-মুসলমানকে যাঁহারা কৃত্রিম বেড়া তুলিয়া পৃথক করিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছেন তাঁহারা মুসলমানেরও বন্ধু নহেন। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে একটা স্বাভাবিক আত্মীয়তার যোগসূত্রকেও যাঁরা ছেদন করিতে চাহেন তাঁহাদের অন্তর্যামী জানেন, তাঁহারা ধর্মের নামে দেশের মধ্যে অধর্মকে আহবান করিবার পথ খনন করিতেছেন। কিন্তু, আশা করিতেছি, তাঁহাদের চেষ্টা ব্যর্থ হইবে।"

বাংলা ভাষা নিয়ে দুর্গতির রকমফের লক্ষ্য করা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে আগ্রাসন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এইসব দুর্গতি থেকে বাংলা ভাষা, সাহিত্যকে 'চির-উদ্যমশীল'  করে রাখতে বাঙালি চিত্তের প্রাণশক্তিকে নব জাগরণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।  " বাঙালি বাংলাদেশে জন্মেছে বলেই যে বাঙালি তা নয়; বাংলা ভাষার ভিতর দিয়ে মানুষের চিত্তলোক যাতায়াতের বিশেষ অধিকার পেয়েছে বলেই সে বাঙালি। " ( জ্যৈষ্ঠ ১৩৩০)। 

আধুনিক কালে এসেও রাষ্ট্রের নানা প্রবাহে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অযাচিত অনাহূত আরোপিত বিভেদের দ্বারা বাঙালির অনৈক্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। বাঙালি সংস্কৃতির বাহন ভাষা, যা ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী জনজাতির সাথে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। এই বৈচিত্র্য আনন্দের মধ্যদিয়ে বৃহৎ সংস্কৃতির নৈকট্য অনুভব করা যায়। " বাংলার সীমার মধ্য থেকে বাংলার সীমার বাহির পর্যন্ত তার আনন্দ বিস্তীর্ণ হচ্ছে।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩০)।

© কামরুল ইসলাম
আগস্ট ৭, ২০২৫
ঢাকা।