রোববার,

১৫ জুন ২০২৫

|

জ্যৈষ্ঠ ৩১ ১৪৩২

XFilesBd

ব্রেকিং

২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থ-উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। মোট বাজেট -৭,৯০,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা-৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি -২,২৬,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬%) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা-৫

কলোনিয়ালিজম (Colonial ) কী? কলোনিয়াল আইন চালু রাখায় পতন ঘটেছে শেখ হাসিনার !!!

ড. অখিল পোদ্দার (Dr. Akhil Podder)

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৯ জুন ২০২৫

আপডেট: ০৫:১৩, ৯ জুন ২০২৫

কলোনিয়ালিজম (Colonial ) কী? কলোনিয়াল আইন  চালু রাখায় পতন ঘটেছে শেখ হাসিনার !!!

দীর্ঘসময় ইংরেজ শাসনের কারণে বাংলাদেশে ‘কলোনিয়াল’ শব্দটি বিশেষভাবে পরিচিত। নিজের চোখে ভারতভাগ দেখেছেন এমন মানুষের সংখ্যাও ক্রমশ কমে যাচ্ছে। সুতরাং কলোনিয়াল স্টেট কিংবা কলোনির রাজনীতি জানা বোঝা বোদ্ধাগণ যারা আছেন তাদের চলনে-বলনে এ শব্দটি বহুদিন ধরেই উধাও। বাংলাদেশে জুলাই আন্দোলন ও শেখ হাসিনার পতেনের পর থেকে বিশেষ একটি শ্রেণির বিবৃতি বক্তৃতায় শব্দটি নতুনরূপে ফিরে এসেছে। কিন্তু কী সেই কলোনিয়াল রাজনীতি?

কলোনিয়ালিজম বা উপনিবেশবাদ এক সময়ের বাস্তবতা ছিল, যার মাধ্যমে ইউরোপীয় শক্তিগুলি আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে দখল করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ চালায়। কিন্তু উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটলেও, “কলোনিয়াল রাজনীতি” নামে একটি কৌশলগত ক্ষমতার খেলা এখনো বিশ্বের বহু দেশে বহাল তবিয়তে চলছে। আধুনিক রাষ্ট্রের কাঠামো, প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈদেশিক সম্পর্কের মোড়কে এটি এখনও বহাল।

ভারতীয় উপমহাদেশে কলোনিয়াল ইতিহাস (বিশেষত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন) নিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য ও সিনেমা তৈরি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো শুধু ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব, প্রতিরোধ, ব্যক্তিগত ও জাতিগত অভিজ্ঞতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র উঠে এসেছে। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ বনাম ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারী-পুরুষ সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে অসাধারণ উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে (১৯১৬ )। ঔপনিবেশিক সমাজের ভেতরে চলমান বিশ্বাসের সংঘাত, ব্রাহ্মসমাজ ও রাডিকাল চিন্তাধারার দ্বন্দ্ব উঠে এসেছে চতুরঙ্গে। কিংবা যারা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ কিংবা দেবী চৌধুরাণী পড়েছেন তারাও সহজে বুঝতে পারবেন কলোনিয়াল রাজনীতি আসলে কী? ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সন্যাসী বিদ্রোহের কাল্পনিক রূপ আনন্দমঠ (১৮৮২)। ‘বন্দে মাতরম্‌’ গান উৎসারিত এখান থেকেই। নারী নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে দেবী চৌধুরানীতে। ভারত বিভাগের পটভূমি তথা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে বিশিষ্ট লেখক সালমান রুশদি লিখেছেন – Midnight’s Children (1981). রুস্কিন বন্ড, খুশবন্ত সিং, নয়ানতারা সহগল, নির্মল বর্মা প্রমুখ কলম ধরেছেন ইংরেজ শাসনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও তার প্রভাব প্রসঙ্গে। সংক্ষেপে বলতে গেলে মুনশী প্রেমচাঁদের Godaan (1936). তাতে সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধিতা না থাকলেও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি ও গ্রামীণ ভারতের শোষণচিত্র রয়েছে। এভাবে আরও অসংখ্যা লেখায়, নাটকে উঠে এসেছে কলোনিয়াল রাজনীতির নানা আখ্যান। মুসলিম নারীর চোখে ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও পারিবারিক সংস্কারের বিবরণ রয়েছে আত্তিয়া হোসাইনের – Sunlight on a Broken Column (1961) এ। কলোনিয়াল ইতিহাস নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের অন্যতম হচ্ছে Lagaan (2001). ঔপনিবেশিক শাসনে গ্রামবাসীদের উপর কর আরোপ এবং তাদের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্রিকেট ম্যাচের মাধ্যমে প্রতিরোধ বিষয় হলেও পরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকর বুঝিয়ে দিয়েছেন কলোনিয়াল রাজনীতি কতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। একইভাবে ভগৎ সিং-এর জীবন ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনের চিত্রায়ন রয়েছে The Legend of Bhagat Singh (2002) এ। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জীবন, অহিংস আন্দোলন এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে রিচার্ড অ্যাটেনবরো নির্মিত করেছেন Gandhi (1982). ভগৎ সিং এবং বিপ্লবীদের জীবন ও আত্মত্যাগ নিয়ে নির্মিত Shaheed (1965) ও Rang De Basanti (2006). এভাবে সরদার প্যাটেলের রাজনৈতিক জীবনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপট Sardar (1993), ভারত বিভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব নিয়ে 1947: Earth (Deepa Mehta, 1998),

ব্রিটিশ ভারতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সময় ভারত ভাগের পটভূমিতে নির্মিত Partition: 1947 / Viceroy’s House (2017), নেতাজীর জীবন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের ইতিহাস নিয়ে নির্মিত Netaji Subhas Chandra Bose: The Forgotten Hero (Shyam Benegal, 2004), নবাবদের নিস্ক্রিয়তা এবং ব্রিটিশদের কূটনৈতিক দখলদারির ব্যঙ্গাত্মক চিত্র উঠে এসেছে পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের Shatranj Ke Khilari (1977) এ। E.M. Forster ব্রিটিশ দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতকে তুলে ধরেছেন A Passage to India তে। বিভাগকালীন সাম্প্রদায়িকতা উঠে এসেছে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত সিংয়ের Train to Pakistan এ  । অমিতাভ ঘোষ তাঁর Sea of Poppies এর মাধ্যমে উপনিবেশ ও বণিক-রাজনীতির আদ্যোপান্ত জানান দিয়েছেন। সুতরাং কলোনিয়াল রাজনীতির প্রভাব ঘুরে-েফিরে নানাভাবে এসেছে আমাদের কাছে। লেখায়-বলায়, ধরণে-ধারণে আমরা সেসব থেকে খুব একটা বেরুতে পারিনি। মাঝে কিছুদিন চেষ্টা করলেও সেই কলোনিয়াল রাজনীতি নতুন করে যেনো চেপে বসেছে আমাদের বুকের ওপর। ব্রিটিশ যুগের বিশেষায়িত সেসব ভবনের রঙ, নকশা এখনও এদেশ থেকে নি:শেষ হয়নি। যেমন সংশোধন করেও শেষ হয়নি ইংরেজ নিয়ম-আইন আর আধিপত্য। তাই এই উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক ইতিহাস শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনেরও চিত্র। এই ইতিহাস সাহিত্যে এসেছে আত্মজৈবনিক, কাল্পনিক, প্রতিরোধমূলক বা দার্শনিক রূপে। সিনেমায় তা হয়েছে দৃশ্যমান, আবেগপূর্ণ ও জাতিগত স্মৃতির পুনর্গঠনে সহায়ক। এই সাহিত্য ও সিনেমাগুলো আমাদের কেবল ইতিহাস জানায় না, বরং আমাদের আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে প্রশ্ন ও নির্মাণ করতে শেখায়।

বাংলাদেশ কি কলোনিয়াল রাজনীতির শিকার?

কলোনিয়াল রাজনীতি বলতে বোঝায় এমন এক ধরণের রাজনীতি, যেখানে একটি জাতি বা জনগোষ্ঠী, বহিঃশক্তি বা অভ্যন্তরীণ অভিজাত শ্রেণির দ্বারা এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, যাতে জনগণের উপর আধিপত্য বজায় রেখে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ চালানো যায়। এই রাজনীতি কেবল ভূখণ্ড দখলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি বহুমাত্রিক চেতনা, ভাষা, প্রশাসন, শিক্ষা ও আইনতন্ত্রের ভেতরেও তার শেকড় গেড়ে বসে। এর কিছু সাদামাটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

ক. প্রশাসন ও আইন ব্যবস্থায় উপনিবেশিক কাঠামোর ধারাবাহিকতা

খ. বিভাজনমূলক শাসন (Divide and Rule)

গ. শিক্ষাব্যবস্থায় চিন্তাভাবনার উপনিবেশিকীকরণ

ঘ. অভিজাত শ্রেণির সহায়তায় জনসাধারণের শোষণ

ঙ. পররাষ্ট্রনীতিতে আত্মনির্ভরতার অভাব

বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক ও বিচারিক কাঠামোর ভিত্তি ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা। আজও ১৮৬০ সালের পেনাল কোড, ১৮৭২ সালের এভিডেন্স অ্যাক্ট, এমনকি ১৮৯৮ সালের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড কার্যকর রয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় পরও এই আইনগুলো সংস্কার না হওয়া, ক্ষমতাসীনদের সুবিধামতো প্রয়োগ, এবং আইনের অসাম্যের ফলে জনসাধারণের মধ্যে উপনিবেশিক শাসনের ছায়া বয়ে চলে। কলোনিয়াল রাজনীতির মূল কৌশল ছিল স্থানীয় এলিট শ্রেণির মাধ্যমে জনগণকে শাসন করা। আজকের বাংলাদেশেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা এক সংকীর্ণ এলিট শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই শ্রেণি রাজনীতি ও অর্থনীতিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যা সাধারণ জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী। এদের জীবনযাত্রা, দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈদেশিক সম্পৃক্ততা অনেকাংশে উপনিবেশিক প্রভুদের মতোই। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজও ব্রিটিশ ম্যাকলে-প্রবর্তিত “ক্লার্ক তৈরির” মডেলের ধারাবাহিকতা। সৃজনশীলতা ও চিন্তার স্বাধীনতা নেই, রয়েছে মুখস্থবিদ্যার চর্চা। একদিকে ইংরেজি মাধ্যমে পশ্চিমাকেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চা, অন্যদিকে সরকারি বাংলামাধ্যমে মানহীন ও বিভ্রান্তিকর পাঠ্যপুস্তক—এই দ্বৈততার মধ্য দিয়ে শিক্ষায় বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। কলোনিয়াল ধারা বজায় রেখে ‘Divide and Rule’ এখনো প্রাসঙ্গিক। ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের মাধ্যমে উপমহাদেশ শাসন করত। আজকের বাংলাদেশেও দলীয় বিভাজন, ধর্মীয় মেরুকরণ, সম্প্রদায়গত উত্তেজনা এবং প্রাদেশিক বৈষম্য (উত্তর বনাম দক্ষিণ, শহর বনাম গ্রাম) রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার হয়। শাসকগোষ্ঠী জনগণের ঐক্যকে দুর্বল রেখে শাসন সহজ করতে চায়—এটি ক্লাসিক কলোনিয়াল কৌশল।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও বাংলাদেশ তার কৌশলগত সিদ্ধান্তে বিদেশি শক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (IMF, WB)-এর প্রভাব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিতে স্পষ্ট। উপনিবেশিক যুগে যেমন উন্নয়নের নামে শোষণ হতো, আজও ঋণের নামে অর্থনৈতিক পরাধীনতা চলছে। বিশ্ব রাজনীতি এখন সরাসরি উপনিবেশ নয়, বরং “নিও-কলোনিয়ালিজম” বা “নতুন উপনিবেশবাদের” দিকে ঝুঁকেছে। এখানে রাষ্ট্রের উপর সামরিক দখল নয়, বরং অর্থনৈতিক শর্ত, বাণিজ্যিক নির্ভরতা ও তথ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আধিপত্য কায়েম হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক মতপ্রকাশের দমন, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নামে একচেটিয়া প্রকল্প—সব মিলে বলা যায়, আমরা এক ধরনের “আধুনিক কলোনিয়াল রাজনীতির” ফাঁদে আটকে পড়েছি। তাহলে সমাধান কি আদৌ মিলবে না? নাকি অন্য কোন পথ খোলা আছে? আইন ও প্রশাসনের আমূল সংস্কার—উপনিবেশিক আইন বাতিল করে নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে নতুন কাঠামো গঠন করলে কিছুটা রেহাই মিলবে। পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তচিন্তা প্রতিষ্ঠা—উপনিবেশিক পাঠ্যক্রমের বদলে নিজস্ব ইতিহাস ও চেতনার ভিত্তিতে শিক্ষা, বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি, প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা—এলিট শ্রেণির পরিবর্তে জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করলে কলোনির অক্টোপাস থেকে মিলবে স্বস্তি।

স্বাধীনতা মানে কেবল যে পতাকা তা তো নয়; এর মানে মানসিক মুক্তি, রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা। বাংলাদেশের বহু অর্জন সত্ত্বেও এখনো অনেক ক্ষেত্রে উপনিবেশিক রাজনীতির ছায়া রয়ে গেছে। এই ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন চেতনার মুক্তি, আইনগত সংস্কার ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।

জুলাই আন্দোলন পরবর্তী শব্দটি কেনো বারংবার উচ্চারিত হচ্ছে?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি নাটকীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে শেখ হাসিনার পতন। প্রায় দেড় দশক ধরে দেশের শাসনক্ষমতায় থেকে একটি স্থিতিশীল অথচ বিতর্কিত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পর হঠাৎ করে গণবিক্ষোভ, রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং তরুণ সমাজের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে এই পতন ঘটে। এই ঘটনায় অনেক কারণ উঠে এসেছে—স্বৈরতান্ত্রিকতা, নির্বাচনবিহীন শাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি। তবে একটি প্রেক্ষিত অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত, অথচ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে তা উঠে আসে—কলোনিয়াল রাজনীতির অনুরণন। অর্থাৎ, শেখ হাসিনার শাসনকালে এমন এক রাজনৈতিক কাঠামো ও শাসনচর্চা গড়ে উঠেছিল, যা উপনিবেশিক শাসনের নকশার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এই রচনায় আমরা বিশ্লেষণ করবো কিভাবে এই কলোনিয়াল রাজনীতি শেখ হাসিনার পতনে ভূমিকা রেখেছে। কারণ আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরে Divide and Rule তথা জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে শাসন ধরে রাখার প্রক্রিয়া, চাটুকার শ্রেণির বিকাশ বা শাসক শ্রেণির আনুগত্যশীল স্থানীয় সুবিধাভোগীদের তৈরি করা, বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের নামে সেন্সরশিপ, নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, দলীয় আনুগত্যে প্রশাসন গড়ে মেরিটের বদলে আনুগত্যের ভিত্তিতে পদবিন্যাস ও জনগণকে রাজনীতির বাইরে রেখে শাসনকে স্বাভাবিকীকরণ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালে বিরোধী দল—বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত, বাম দল, নাগরিক সমাজ এমনকি নিরপেক্ষ চিন্তাবিদরাও দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, র‌্যাব ও পুলিশের অতিরিক্ত ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে একটি ভয় ও নিরুৎসাহের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এটি স্পষ্টভাবে ব্রিটিশ আমলের ‘Public Safety Act’ বা ‘Rowlatt Act’-এর চর্চার অনুরূপ। একইভাবে উপাচার্য থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসক, পুলিশ অফিসার, জজ—সবক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যই হয়ে ওঠে নিয়োগের প্রধান মানদণ্ড। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ একচেটিয়া দখল নেয়। প্রশাসনের এই দলীয়করণ ব্রিটিশ আমলের ‘native loyalist collaborator’ উৎপাদনের নীতির স্মরণ করিয়ে দেয়। শেখ হাসিনার শাসনকালে একটি ব্যবসায়ী ও মিডিয়া মালিক শ্রেণি গড়ে ওঠে যারা সরাসরি সরকারপন্থী। এই শ্রেণি কর্পোরেট লুট, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ঋণখেলাপি এবং মিডিয়া কন্ট্রোলে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। এটি ব্রিটিশ আমলে ‘zamindar-collaborator class’-এর নতুন রূপ। আর এসব কারণে ক্রমশ ছাত্রসমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। এমনকি শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের বহুসংখ্যক নেতা কর্মী এই আধিপত্যবাদের শিকার হয়েছেন নিজের দলের ক্ষমতাধরদের হাতে। পদে পদে হয়েছেন নিগৃহি, লাঞ্চিত, অপমানিত। এই শ্রেণির লোকজন কোথাও বিচার দিতে পারেননি। নিরবে নিভৃতে ব্যক্তি ও ক্ষমতার কাছে পদদলিত হয়েছেন। ফলে Divide and Rule-এর আধুনিক প্রয়োগ ঘটেছে। শিক্ষাঙ্গনে, রাজনৈতিক পরিসরে এবং সামাজিক স্তরে বিভাজনের ফাঁকে গড়ে উঠেছে বিকল্প। যেমন: ছাত্রলীগ বনাম অন্যান্য ছাত্র সংগঠন, সুশীল বনাম ‘সরকার বিরোধী’ বুদ্ধিজীবী ও ডিজিটাল অ্যাক্টিভিস্ট বনাম ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’এর জন্ম হয়েছে। এই বিভাজন ব্রিটিশ রাজনীতির “divide and rule” কৌশলের আধুনিক প্রয়োগ ছাড়া কিছু নয়। তবে এই কৌশল একসময় পরিণত হয় ব্যুমেরাংয়ে—কারণ বিভক্ত জনগণ যখন জোটবদ্ধ হয়, তখন সরকারের পতন আরও দ্রুত ঘটে এবং আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসন একসময় জাতীয়তাবাদের বদলে প্রশাসনিক আধিপত্যের রাষ্ট্রীয়তা প্রতিষ্ঠা করে। এতে করে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা, যার ভিত্তি ছিল জনগণের অধিকার ও অংশগ্রহণ—তা হারিয়ে যায়। এর বিপরীতে উঠে আসে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে জনগণ নয়, বরং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ইচ্ছাই সবকিছুর নিয়ন্তা। Gen Z এই দ্বন্দ্বটি বুঝে ফেলে। তাদের দৃষ্টিতে শেখ হাসিনা তখন আর ‘মুক্তির নায়ক’ নন, বরং ‘নতুন যুগের শাসক’—যার নীতি ব্রিটিশ রেজিমের কাছাকাছি। এই বৈপরীত্য থেকেই রাজনৈতিক বিপ্লবের জোয়ার তৈরি হয়। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে Gen Z একটি ভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় বেড়ে উঠেছে। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, বিশ্বরাজনীতির সাথে সংযোগ, স্বাধীনচেতা শিক্ষা এবং গণতন্ত্রকামী মনোভাব তাদের গড়ে তুলেছে একধরনের “post-colonial citizen” হিসেবে। তাদের মনে শাসকের প্রতি সন্দেহ, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং অধিকারের প্রতি দাবি দৃঢ় হয়েছিল। তারা বুঝতে পারে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত, কর্মসংস্থান অনিশ্চিত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব, এবং এইসবের পেছনে রয়েছে একটি আধুনিক-কলোনিয়াল রাজনৈতিক কাঠামো। ফলে তারা শেখ হাসিনার সরকারকে “স্বাধীন দেশে পরাধীন শাসনব্যবস্থার” প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলে।

আরেকটি বড় কারণ হয়ে ওঠে শেখ হাসিনার বহির্বিশ্বিয় পন্থা ও নীতি। কৌশলগতভাবে চীন, ভারত এবং পশ্চিমা শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে গেছেন। যদিও এটি কূটনৈতিকভাবে চতুর ও দেশের জন্য যারপরনাই উন্নয়ন করেছেন। ক্ষমতাধর দেশগুলোর হুমকি ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একের পর এক বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন কিন্তু অনেকের কাছে এটি ছিল ‘external dependency’-এর আরেক রূপ।

আন্তর্জাতিক আনুগত্য এবং অভ্যন্তরীণ দমননীতি মিলিয়ে অনেকেই শেখ হাসিনাকে এক প্রকার ‘neo-colonial administrator’ হিসেবে দেখতে শুরু করে—যিনি জাতিকে পরিচালনা করছেন ঠিকই কিন্তু জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন নাই-বিষয়টা যেনো এমনই। শাসনব্যবস্থায় প্রচণ্ড সেন্সর, মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ, অনলাইনে নজরদারির ভয় দেখিয়ে বিরোধী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করার কৌশল—সবই একধরনের মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশিকতা (psychological colonialism) তৈরি করে। ফলে একটি “তুমি কিছু বলতে পারো না” জাতি তৈরি হয়, ঠিক যেমনটা ব্রিটিশ আমলে গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক সমাজে—বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে—এই কৌশল কার্যকর থাকেনি। বরং এই ভয়ের সংস্কৃতি ভেঙে দিয়েছিল Gen Z-এর TikTok, Facebook Live, YouTube Channel, Podcast—যারা সত্য বলেছে ও শুনিয়েছে। সুতরাং শেখ হাসিনার পতন শুধু একদল বা একজন নেতার পতন নয়, এটি একটি শাসন ধারণার পরাজয়। যে ধারণা উপনিবেশিক শাসনের কৌশল—দমন, বিভাজন, আনুগত্যভিত্তিক প্রশাসন, মনস্তাত্ত্বিক ভয়—এই সবের উপর ভর করে দাঁড়িয়েছিল, তা ২১ শতকের বাস্তবতায় ধসে পড়ে।

তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনা, প্রযুক্তির বিকাশ, অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিক্রিয়া এবং সর্বোপরি নতুন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা—এসব একত্র হয়ে কলোনিয়াল শাসনের ছায়াকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই বলা যায়, শেখ হাসিনার পতনে কলোনিয়াল রাজনীতি সরাসরি নয়, তবে গভীর কাঠামোগতভাবে ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে।