শুক্রবার,

০৩ অক্টোবর ২০২৫

|

আশ্বিন ১৭ ১৪৩২

XFilesBd

যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েও রেহাই মিলছে না অধিকারকর্মীর

ডকুমেন্টারি তৈরীর জেরে সাংবাদিকের বাড়িতে হামলা। আতঙ্কে পারিবার। দিচ্ছে হত্যার হুমকি

বিশেষ প্রতিনিধি নিউ ইয়র্ক ও ঢাকা

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৯:২৫, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ডকুমেন্টারি তৈরীর জেরে সাংবাদিকের বাড়িতে হামলা। আতঙ্কে পারিবার। দিচ্ছে হত্যার হুমকি

প্রাণের ভয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন গণমাধ্যমকর্মী শিউলী সিকদার। সেখানে গিয়েও শেষরক্ষা হয়নি। তাঁকে না পেয়ে মিসেস সিকদারের পরিবারের ওপর নতুন করে হামলা হয়েছে। বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়ে গেছে প্রাণে মেরে ফেলার। কারণ শিউলী সিকদার নিউ ইয়র্কে অবস্থান করে একটি আলোচিত প্রামাণ্যচিত্র তৈরী করেছেন যাতে উঠে এসেছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী নিধনের বহুমাত্রিক ধরণ। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ইউএসএ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘ইয়াহিয়া টু ইউনুস’ নামে ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। যাতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে দেশটির বর্তমান নাজুক চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের নেপথ্যে প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টার ছিলেন গণমাধ্যমকর্মী শিউলী সিকদার। অনুষ্ঠানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ঘটে যাওয়া অন্যায় অত্যাচারের ধারাবাহিক বর্ননা তুলে ধরেন তিনি। সহকারি নির্দেশক ও ভিডিও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করলেও পর্দার আড়ালে শিউলী সিকদার মূলত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দায়িত্বই পালন করেছেন। আর এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে অধিকার হারিয়েছেন, হত্যা-হামলার শিকার হচ্ছেন তার বর্ননা করে বক্তব্য দেন গেল ১৬ বছর ধরে সিনিয়র ভিডিও এডিটরের দায়িত্ব পালন করা সংবাদকর্মী ও একটিভিস্ট শিউলী সিকদার।

ঐ অনুষ্ঠানের অন্যতম অতিথি বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরীন প্রামাণ্যচিত্রের যারপরনাই প্রশংসা করেন। তুলে ধরেন এই সময়ের সাহসী পদক্ষেপও সময়ের চিত্র। অনুষ্ঠানের লাইভ চলাকালে মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তসলিমার বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে। আর সেটাই কাল হয়ে যায় শিউলী সিকদার ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য। যাদের বসবাস বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম ও ঢাকা শহরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছর খানেক আগে এক মাসের ব্যবধানে শিউলী সিকদারের বাড়িতে চার বার হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসীরা মূলত শিউলীকে হত্যার উদ্দেশ্যেই বারংবার তাঁর গ্রামের বাড়িতে আক্রমণ করেছিল। তাঁকে না পেয়ে এবারও ভিন্নভাবে হামলা চালায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। শিউলী সিকদার কিছুদিন আগেও  জনপ্রিয় টেলিভিশন একুশে টিভির সিনিয়র ভিডিও এডিটর পদে কর্মরত ছিলেন। প্রাণের ভয়ে তিনি ঢাকার উত্তরা ও তেজগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পুলিশকে সরাসরি অভিযোগও দেন। কিন্তু কোন ফল না পেয়ে গত বছরের নভেম্বরের কোন এক সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। আমেরিকা যাবার আগে প্রায় এক যুগ ধরে তিনি সাধারণ মানুষের অধিকার, সংখ্যালঘু নির্যাতন, পাহাড়ি ও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ওপর হামলার প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। আয়োজন করেছিলেন একাধিক মিছিল সমাবেশ ও প্রতিবাদী আলোচনাসভার। নিউ ইয়র্কে পৌঁছে তিনি বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন, অধিকার হরণ, ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে সংগ্ৰাম চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সেই নিরীখে গত ২৬ জুলাই ২০২৫ বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ইউএসএ কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘ইয়াহিয়া টু ইউনুস প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করেন তিনি।

উল্লেখিত প্রামাণ্যচিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের কিছু লোক শিউলী সিকদারের বাড়ি গিয়ে নতুন করে হত্যা ও হামলার হুমকি প্রদর্শন করে। বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি এখন এই দুই দলকেই মনে করেন কেউ কেউ। যে কারণে এদের বিরুদ্ধে কথা বলার দুঃসাহসও নেই অনেকের। গ্রামের লোকজন জানিয়েছে, শিউলীর অবর্তমানে তার প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা বাবা নিখিল সিকদারের সমাধিসৌধ নিশ্চিহ্ন করে দেয় মোল্লারা। তার বৃদ্ধা মা দূর্গা রানী সিকদারকে ঠেলে ফেলে দেয় ও অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করে। জ্বালিয়ে পুড়ে মারার হুমকিও দেয় সন্ত্রাসীরা। এ সময় শিউলী সিকদারের ভার্সিটি পড়ুয়া দুই মেয়েকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে। দ্রুততম সময়ে প্রতিবেশীরা সোচ্চার হওয়ায় সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। যাবার পথে সাংবাদিক শিউলী সিকদারের নাম ধরে যাচ্ছেতাই ভাবে গালিগালাজ করে। এ অবস্থায় শিউলী সিকদারের দুই কন্যা, ভাই, মা ও তাঁর স্বামী চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সন্ত্রাসীরা চিৎকার করে উঠোনে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন-শিউলী নিউ ইয়র্কে গিয়ে নাস্তিক তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে যোগ দিয়ে জিহাদীদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তাই তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তাকে পেলে ইসলামি শরিয়া মোতাবেক দোররা মারা হবে।প্রামাণ্যচিত্র অনুষ্ঠানের লাইভ চলাকালে নির্বাসিত ও নারীবাদী লেখিকা, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী তসলিমা নাসরিনের বক্তব্য অনেকেই শুনেছিলেন। সেই থেকে সন্ত্রাসীরা হন্যে হয়ে শিউলী সিকদারকে খুঁজছে। তাঁকে না পেয়ে তার মেয়ে, স্বামী ও ভাইকে হুমকি দিচ্ছে।

উল্লেখ্য শিউলী সিকদার মাগুরা জেলা সদরের নতুন বাজার এলাকার সমাজকর্মী নিখিল কুমার সিকদারের মেয়ে। যিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক ও পেশাগত জীবনে পুলিশের অফিসার ইনচার্জ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী দূর্গা রানী সিকদার নতুন বাজার এলাকার বাড়িতে একাই থাকতেন। মাঝেমধ্যেই শিউলী সিকদার নি:সঙ্গ মায়ের সঙ্গে এ বাড়িতে থাকতেন। তার স্বামী ও মেয়েরা রাজধানী ঢাকা থেকে এ বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনীতিতে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়। সাথে সাথে ইসলামী ভাবধারার একাধিকগোষ্ঠী রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।